সময় ডেস্ক ॥ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে করা মামলা পরিচালনার জন্য ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েও তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। তাদের নিয়ে করা একটি প্রকল্প কার্যক্রমে জাতিসংঘ এবং ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হলেও দুঃখজনকভাবে তারা তেমন কোনো সহযোগিতা করেনি। এছাড়া আমেরিকা, ভারত, চীনসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোও বিষয়টি সমাধানের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিয়ে এ ধরনের অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (মিয়ানমার), যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত, সংসদীয় কমিটির সভাপতিসহ এমপিরা বৈঠকে অংশ নেন। সম্প্রতি ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী প্রকাশ করা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) এ একটি মামলা চলমান আছে যা পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক অর্থের প্রয়োজন। এ ব্যপারে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর কাছে আর্থিক সহায়তা চাওয়া হলেও তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। তবে আইসিজি এর অন্তর্র্বতীকালীন রায় বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছে বলে তিনি জানান। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত আছে। বিভিন্ন মিটিংয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও বাস্তবে তারা কোনো কথাই রক্ষা করছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করলে সমস্যাটি সমাধানের পথ উন্মুক্ত হতো। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রভাবশালী ও প্রতিবেশী দেশসমূহের দ্বি-মুখী নীতির বিষয়ে আইন প্রণেতা, সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের মিডিয়ায় আরো সোচ্চার হওয়া দরকার বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। একই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. খোরশেদ আলম বলেন, স্থানটির নাম ভাসানচর হওয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সেখানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়ে আসছে। ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য প্রায় আড়াইহাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠান ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আবাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সাইক্লোন শেল্টার ইত্যাদি তৈরি করেছে। এই কার্যক্রমের সঙ্গে জাতিসংঘ এবং ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হলেও দুঃখজনকভাবে তারা তেমন কোনো সহযোগিতা করেনি। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (মিয়ানমার) বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপ্রাণ চেষ্টার পরেও মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে রোহিঙ্গাদের সেদেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে উল্ল্যেখযোগ্য তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এই কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা রাষ্টগুলোর উপর ভরসা করা হলেও তারা মূলত এই বিষয়টি সমাধানের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। তিনি বলেন, অপরদিকে মিয়ানমার যাতে আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝুঁকে না যায় সেজন্য চীনও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসনের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের উপর তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করছে না। বৈঠকে কমিটির সভাপতি ফারুক খান রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে একটি গুরুত্বপুর্ন রাষ্ট্র এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সহযোগিতা পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখালেও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। ভারত প্রসঙ্গে কমিটির সভাপতি বলেন, রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক অনেক আলোচনা হলেও সমস্যা সমাধানের বিষয়ে ইতিবাচক কোনো দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে না বরং মাল্টিলেচারাল সাপোর্ট (বহুমূখী সহায়তা) দিন দিন কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশ। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন এবং মিয়ানমারকে মিসাইল সরবরাহ করে প্রকারান্তরে মিয়ানমারকেই সমর্থন দিচ্ছে। ভারতের এই দ্বিমুখী ভূমিকা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে একটি অন্তরায়-যা খুবই দুঃখজনক বলে তিনি মনে করেন। নিজের মতামত দিতে গিয়ে ফারুক খান বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটিৈনতক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোরালো সমর্থন নিশ্চিত করে প্রত্যাবসন কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। এদিকে ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত মো. শহিদুল ইসলাম কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন ও আলোচনা করেন। সে সময় তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবিলা, যুক্তরাষ্ট্রের ভিভিআইপি, ভিআইপি পর্যায়ে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা, বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনা, করোনা মহামারি মোকাবিলা, কংগ্রেসনাল ককাসকে সক্রিয় করা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়ে তিনি নিবেদিতভাবে কাজ করবেন বলে কমিটিকে আশ্বস্ত করেন। এছাড়া ওই বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সংসদ সদস্য আবদুল মজিদ খান, নাহিম রাজ্জাক ও কাজী নাবিল আহমেদ।