,

হবিগঞ্জে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা প্রসঙ্গে কিছু কথা

শাহ ফখরুজ্জামান : বর্তমানে বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিষয় করোনা ভাইরাস সংক্রমন। কোথায় মৃত্যুর মিছিল, কোথায় ছোট্ট এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণা আর কোথায় নতুন সম্ভাবনা সেদিকেই সকলের মনযোগ। করোনা নিয়ে ট্যাকনিক্যাল লোকজনের বাইরে উন্মুক্ত ডাটার সুযোগ নিয়ে নন ট্যাকনিক্যাল লোকজনও বনে গেছেন বিশেষজ্ঞ। লিখে ফেলছেন দুই কলম। আমরা যদিও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কেউ নই, তারপরও গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে পেশাগতভাবেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চর্চার অবকাশ থেকে যায়। সেই আলোকে হবিগঞ্জে করোনা পরীক্ষা এবং চিকিৎসা নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণের আলোকে এই লেখার অবতারণা। আমি কয়েকদিন পূর্বে একটি রিপোর্ট করেছিলাম হবিগঞ্জে করোনা পরীক্ষার ল্যাব করার জন্য। শুরুতে আইইডিসিআরেই সারাদেশের করোনা পরীক্ষা হতো। যে কারণে পরীক্ষার সংখ্যা ছিল কম। পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৭টি ল্যাব করা হয়। এর মাঝে ছিল সিলেটের এমওজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালও। সিলেট একটি বিভাগীয় শহর হওয়ায় বড় কোন উদ্যোগ থাকলে তার কেন্দ্রবিন্দু হয় ওই শহর। কিন্তু কোন সময়ই ট্যাকনিক্যাল সুবিধা বিবেচনা করা হয় না। যেমন বহু আগে যখন সিলেটে বিমানবন্দর করা হল তখন তা পুরো সিলেটবাসীর সুবিধা নিশ্চিত হয়নি। যদি শেরপুর এলাকায় ওই বিমান বন্দর হতো তাহলে বিভাগের ৪টি জেলাই সমানভাবে উপকৃত হত। তবে সিলেটে করোনা পরীক্ষার একটি ল্যাব হওয়া নিশ্চয় অযৌক্তিক নয়। তবে এর মাধ্যমে আমরা কিন্তু পুরোপুরি উপকৃত হচ্ছি না। হাওর এলাকার নাভী খ্যাত হবিগঞ্জে করোনা পরীক্ষার জন্য আলাদা একটি ল্যাব প্রয়োজন অনেকগুলো যৌক্তিক কারনে। সেই যৌক্তিকতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হতে শুরু করেছ। আমি যেদিন রিপোর্ট করি সেদিনের সিলেট ল্যাবের তথ্য ছিল সেখানে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩শ’ রোগীর
নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মাঝে হবিগঞ্জের ছিল ৮০৬ জন। আজ যখন এই লিখা তৈরি করছি তখন হবিগঞ্জ জেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮ জন। যেখানে সুনামগঞ্জে ১৩, সিলেটে ১২ ও মৌলভীবাজারে ৭ জন। আর সর্বশেষ আপডেট হল সিলেট ল্যাবে হবিগঞ্জ থেকে প্রেরণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪০৭জন। যেখানে সুনামগঞ্জ থেকে ৫৮৭, সিলেট থেকে ৪৫২ ও মৌলভীবাজার থেকে ৩৫৭জনের নমুনা প্রেরণ করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকেই আমার দাবীর যৌক্তিকতার প্রমাণ মিলে। আবার এটিও প্রমাণ হয় হবিগঞ্জ থেকে বেশী নমুনা প্রেরণ করা হয় বলেই আক্রান্তের সংখ্যা বেশী। হবিগঞ্জ ল্যাব প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা নিয়ে আমি দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের যারা নীতি নির্ধারক তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। অনেকের নাম্বার পাই বন্ধ। আবার অনেকেই ফোন রিসিভ করননি। বিএমডিসির প্রেসিডেন্ট ও করোনা প্রতিরোধে জাতীয় পরামর্শ কমিটির আহবায়ক ডা. শহীদুল হককে বার বার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে ফোন করি করোনা প্রতিরোধে জাতীয় পরামর্শ কমিটির সদস্য সচিব ও আইইডিসিআর এর পরিচালক মীরজাদী ডা. সেব্রিনা ফ্লোরাকে। যার শাড়ী নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় অনেক ট্রল হয়েছে। তার ফোনটি দীর্ঘক্ষণ ওয়েটিংয়ে ছিল । আমি ধৈর্য্য নিয়ে একাধিবার ট্রাই করার পর তিনি ফোন ধরেন। পরে আমার পরিচয় দিয়ে হবিগঞ্জে ল্যাব প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তুলে ধরে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাই। তখন তিনি বলেন, এই
ল্যাবগুলো হাইলি স্কিল্ড ল্যাব। এগুলো মলিকোলার বাইলজিক্যাল ল্যাব। যে কোন স্থানে চালু করা যাবে না। আমরা এসেস করে বিভিন্ন স্থানে ল্যাব চালু করেছি। যেখান থেকে জীবাণু ছড়িয়ে পড়বে না সেখানেই সেটি করা হয়েছে। আমরা পর্যায়ক্রমে আরও ল্যাব করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তার সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি কার্যকরী যোগাযোগ করা হলে পরবর্তী ধাপে আমাদের এখানে একটি ল্যাব পাওয়া যেতে পারে। তার কথার ধরন থেকে বুঝতে পেরেছি করোনা নিয়ে যে কোন পর্যায় থেকেই যোগাযোগ করা হউক না কেন তিনি তাতে সাড়া দেন। হবিগঞ্জ থেকে যখন নমুনাগুলো গ্রহণ করা হয় তখন তা সিভিল সার্জন অফিসে একত্রিত করে আইইডিসিআর অথবা সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবে প্রেরণ করা হয়। এতে করে ঢাকায় নমুন প্রেরণ করতে ৪/৫ ঘন্টা এবং সিলেটে নমুনা প্রেরণ করতে লাগে ২/৩ ঘন্টা। সকল উপজেলাগুলোর নমুনা একত্র করতে আরও কয়েক ঘন্টা সময় ব্যয় হয়। প্রয়োজন হয় পরিবহণ ও জনবলের। অথচ হবিগঞ্জে ল্যাব হলে সহজে এবং আরও কম সময়ে বেশী পরিমাণ পরীক্ষা করা সম্ভব। পাশাপাশি ল্যাব থেকে সুবিধা নিতে পারবে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার বেশ কিছু এলাকা। এমনকি নরসিংদী জেলা থেকে ঢাকায় নমুনা প্রেরণ করে ফলাফল এর সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা না করে সমান দুরত্ধেসঢ়;¦র হবিগঞ্জে আসতে পারে। হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের নতুন নির্মিত ২৫০ শয্যা ভবনে এই ল্যাব করা যেতে পারে। ইদানিং আরেকটি বিষয় আমাদের কানে আসছে সেটি হল সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই নাকি আইইডিসিআর এ লবিং করি রিপোর্ট টেম্পারিং করেন। এর উদ্দেশ্য সরকারের দেয়া ৫ লাখ টাকার
সুবিধা গ্রহণ অথবা নিজেকে ডিউটি থেকে কৌশলে সরিয়ে রাখা। তবে আমার কাছে এই কথা বিশ^াস হয়নি। তবে যেহেতু আমরা বাঙ্গালিরা সন্দেহপ্রবণ তাই এই সন্দেহ দূর করতে পজেটিভ রিপোর্ট আসাদের মাঝে দৈব চয়ন বাছাইয়ের মাধ্যমে পুনরায় নমুনা নিয়ে ভিন্ন কোন ল্যাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এবার আসি করোনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা প্রসঙ্গে। আমার এক সিনিয়র আইনজীবী বকুল ভাই আমাকে এ ব্যাপারে বার বার লেখার
অনুরোধ করেছেন। তার পরামর্শ হল করোনায় আক্রান্ত রোগীকে টানা হেছড়া করে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে না আসার জন্য। কারণ এতে করে যারা তাদেরকে আনা নেয়া করে এবং যারা চিকিৎসা করে তারা ঝুকিতে পড়ে যাবে। প্রশাসন ও পুলিশ বিষয়টি তদারকি করতে গিয়ে তারাও ঝুকিতে পড়ে যাবে। এতে করে প্রশাসনিক সিস্টেম ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। বিদেশে মুমূর্ষ রোগী না হলে হাসপাতালে আনা হয় না। যাদের আইসিইউ এবং ভেনটিলেশন প্রয়োজন তাদেরকেই আনা হয় হাসপাতালে। তার এই কথার যৌক্তিকতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হচ্ছে। আর হাসপাতালে এনে কি এমন চিকিৎসা দেয়া হবে তাদেরকে। এর ছেয়ে প্রত্যেক রোগীর বাড়িতেই আইসোলেশন এর ব্যবস্থা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একজন রোগী আছে জানলে ওই এলাকার লোকজনই তাকে আইসোলেশনে থাকতে বাধ্য করবে। আর আক্রান্ত লোক পারিবারিকভাবে ভাল সেবা ও খাদ্য পাবে। পরিবারের সদস্যদের চিন্তা করে রোগীও বাস্তবতা মেনে নিবে। আমার দুই সাংবাদিক সহকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে তাদের পরিচিত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কি পরিমাণ দুর্ভোগে পড়েছে তা নিয়ে আমার সাথে আলাপ করেছেন। একজন সহকর্মী রোগীর এই দুঃখ কষ্ঠ নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন। এতে করে মনে হচ্ছে করোনায় আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এসে তাকে আরও বিপদগ্রস্থ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিপদগ্রসস্থ হচ্ছেন চিকিৎসকসহ চিকিৎসা কাজে সংশ্লিষ্টরা। আর এই বিষয়টি তদারকি করতে গিয়ে বিপদগ্রস্থ হচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আমার পরামর্শ হল যেহেতু হবিগঞ্জে আইসিইউ এবং ভেনটিলেশন সুবিধা নেই তাই মুমুর্ষ রোগী হলে ঢাকা ও সিলেটে প্রেরণ করা। মাঝারি অবস্থা হলে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের আইসোলেশনে নিয়ে আসা। কিছুটা খারাপ হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসোলেশনে ভর্তি করা। আর যাদের বাড়ীতে আইসোলেশন এর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয় সেই এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা। আর সাধারন রোগীকে নিজ বাড়ীতেই আইসোলেশনে রাখা। ঢালাওভাবে যেন সবাইকে জেলা সদরে নিয়ে আসা না হয়। আর মনিটরিং এর জন্য তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে। আমরা যদি এ ব্যাপারে পরিকল্পিতভাবে না আগাই তা হলে আমাদের সামনে আরও বড় ধরনের বিপর্যয় অপেক্ষা করছে বলে একজন মিডিয়া কর্মী হিসাবে আমি মনে করি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরো খবর
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.