শাহ ফখরুজ্জামান : দেশে করোনা পরীক্ষার জন্য একের পর এক চালু হচ্ছে পিসিআর ল্যাব। গত ৪মে চালু হয়েছে নোয়াখালীতে। আমরা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কারণ করোনা মোকাবেলায় সবার আগে প্রয়োজন করোনা শনাক্ত করা। এতে করে আক্রান্ত ব্যাক্তির যেমন চিকিৎসা নিশ্চিত হবে তেমনিভাবে তা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বন্ধ করবে। আমি এর আগে একটি লেখায় হবিগঞ্জে করোনা পরীক্ষার ল্যাব প্রতিষ্ঠার দাবী এবং এর যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলাম। ওই লেখায় এক সাথে কয়েকটি বিষয় আলোকপাত করেছিলাম। এতে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছিল। আবার কোন একটি ইস্যুকে ভিন্নভাবে সমালোচনাও করা হয়েছে। কোন বিষয় নিয়ে মত ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক বলে আমি মনে করি। তবে সেই লেখায় আমার নিজস্ব মতামতের পাশাপাশি অডিয়েন্স কি বলছে এবং সমাধান কি হতে পারে তার সুপারিশ প্রস্তাবনা ছিল। একটু গভীরভাবে উপলদ্ধি করলে বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়ার কথা ছিল না। আজ যে বিষয়টির আলোকপাত করব সেটি ওই লেখারই ধারাবাহিকতা। পূর্বের লেখায় সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলার করোনার নমুনা প্রেরণের তথ্য উপাত্ত দিয়ে এবং ভৌগলিক কারণে আশ পাশের জেলার সুবিধা উল্লেখ করে হবিগঞ্জের শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে করোনা পরীক্ষার ল্যাব করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলাম। আজ আরও কিছু প্রাসঙ্গিক কারন তুলে ধরব। মিডিয়ার কল্যাণে ইতোমধ্যে দেশ বিদেশে সবাই জেনে গেছেন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসানের করোনা শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু এটি কেউ জানেননা তার নমুনা কবে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং ফলাফল কবে এসেছে। হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসানসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা গত ২১ এপ্রিল তাদের নমুনা দেন করোনা পরীক্ষার জন্য। শারিরিক কোন সমস্যা না থাকায় নমুনা দেয়ার পরও দিনরাত মাঠে ময়দানে কাজ করতে থাকেন জেলা প্রশাসকও তার সহকর্মীরা। এরই মাঝে ২৬ এপ্রিল রিপোর্ট আসে জেলা প্রশাসনের এডিএম, দুইজন ম্যাজিস্ট্রেট ও নাজির করোনা আক্রান্ত। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যারা আক্রান্ত তাদের রিপোর্ট আসে প্রথম। নেগেটিভ রিপোর্ট পরে আসে। ফলে তিনি দিন রাত মাঠে ময়দানে কাজ করতে
থাকেন। রবিবার তিনি সারাদিন চুনারুঘাট উপজেলায় দরিদ্রদের মাঝে ইফতার বিতরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেন। পরদিন সোমবারও যখন বাহিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন তখন ১৩দিন পর তিনি জানতে পারেন তার করোনা পজেটিভ। এই রিপোর্টে তিনি হতবাক হয়ে পড়েন। শুপরে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সোমবার পুনরায় নমুনা প্রেরণ করেন। শুধু তাই নয় তার সাথে আরেকজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটও ওই ১৩ দিনের গ্যাড়াকলে পড়ে করোনা পজেটিভ হয়েছেন। এখানে প্রশ্ন হল একই সাথে নমুনা দেয়ার পর ২৬ এপ্রিল তার ৪ সহকর্মীর রিপোর্ট আসল আর তারটি এবং ওই নারী ম্যাজিস্ট্রেট এরটি কেন আসল না। ২৬ এপ্রিল করোনা পজেটিভ হওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম তার অন্যান্য সহকর্মীসহ সার্কিট হাউজে চলে যান আইসোলেশনে। কিন্তু বাসায় থাকা স্ত্রীকে নিয়ে তিনি হয়ে পড়েন উদ্বিগ্ন। শারিরিক কিছু সমস্যা থাকায় উৎকণ্ঠা বেড়ে যায় আরও বেশী। ২৭ এপ্রিল তারও নমুনা নেয়া হয় পরীক্ষার জন্য। প্রতিদিন ফলাফলের অপেক্ষার প্রহর গুনেন ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম। সোমবার তিনি জানতে পারেন তার স্ত্রীর রিপোর্ট এসেছে নেগেটিভ। ফলে তিনি স্বস্থির নিঃশ^াস ফেলেন। হবিগঞ্জে করোনা পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে এ ধরনের চলছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। আর ফলাফল আসতে বিলম্ভ হওয়ায় কোন সমস্যা নেই মনে করে সরকারী সেবা দিতে গিয়ে হুমকিতে পড়েছেন অনেক কর্মকর্তা ও তার পরিবারের
সদস্য এবং সহকর্মীরা। এতে করে বাড়ছে ঝুকি। সিলেটে ৪দিন পূর্বে ৭৮ জনের করোনা শানাক্তের রিপোর্ট আসলেও তা প্রকাশ করা হয় মঙ্গলবার দুপুরে। মঙ্গলবার চুনারুঘাট থানার ওসিসহ ৫ পুলিশ সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তারা নমুৃনা দিয়েছিলেন ২৩ এপ্রিল। ৪দিন পূর্বেই তাদের রিপোর্ট সিলেটে চলে আসলেও সর্টিং সমস্যার জন্য আসতে বিলম্ভ হয়েছে। ওই সময়ে মাঝে তারা পরিবারে সাথে মিশেছেন এবং সরকারী দায়িত্বও পালন করেছেন। এতে তাদের পরিবারও পড়েছে হুমকির মুখে। আক্রান্তের সম্ভাবনা রয়েছে তাদের সহকর্মীদের এবং তারা যাদেরকে সেবা দিয়েছেন তারাও। আসলে আমরা এতদিন পরীক্ষার ফলাফল আসার বিলম্ভকে নেগেটিভ রিপোর্ট মনে করে মাইন্ড সেট আপ করে ফেলেছি। বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ থাকায় আমাদেরকেও এ ধরনের ধারণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটি যে কত বড় ভূল তা আজ প্রমাণিত হয়েছে। না জানি এই ভূলের মাসুল আমাদেরকে কি দিতে হবে। এদিকে হবিগঞ্জে যখন ১ম করোনা রোগী শনাক্ত হয় সেই নারায়নগঞ্জের ট্রাক ড্রাইভারকে গত ৯ এপ্রিল হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসার নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তার নমুনা কিছুদিন পর পর পরীক্ষা করা হয় উন্নতি হচ্ছে কিনা। গত ২১ এপ্রিল তার নমুনা প্রেরণ করা হয়েছিল পরীক্ষা করার জন্য। পরে ২৬ এপ্রিল প্রেরণ করা হয় ২য় নমুনা। কিন্তু তার ২য় পরীক্ষার ফলাফল আসে ৪ মে । এটি ছিল নেগেটিভ। পরে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ গতকাল ৫ মে যোগাযোগ করে ২১ এপ্রিল প্রেরিত নমুনার ফলাফল আনে। এটিও আসে নেগেটিভ। ফলে তাকে করোনা মুক্ত ঘোষণা দিয়ে গতকাল তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রিলিজ দেয়। যদি ফলাফল আসতে বিলম্ব না হত তাহলে ওই রোগী অনেক আগেই মুক্তি পেয়ে যেত। আমার ধারনা আইসোলেশনে থাকা আরও অনেক করোনা রোগী ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে গেছেন। কিন্তু ফলাফল আসার বিলম্ভের জন্য তারা রিলিজ পাচ্ছেন না। হবিগঞ্জ জেলার সর্বোচ্চ নমুনা প্রেরণ আর সর্বোচ্ছ আক্রান্তের পাশাপাশি ভাল হয়ে যাওয়া রোগীকে যথা সময়ে রিলিজ দেয়ার জন্য হলেও আমি মনে করি হবিগঞ্জে দ্রুত ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা দরকার। আর কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের কথা পূর্বেই বলেছি। তবে হতাশাজনক খবর হল আবারও সেই কেন্দ্রীভূত থাকার প্রবণতায় সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে ল্যাব থাকার পরও এর ৫ কিলোমিটারের মধ্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে করা হচ্ছে আরেকটি ল্যাব। সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. আনিছুর রহমান আমাকে বলেছেন সেখানকার ল্যাবের জন্য পিসিআর মেশিন বিদেশ থেকে মেশিন চট্টগ্রাম বন্দরে চলে এসেছে। এখন সেটি আসলেই ল্যাব চালু হয়ে যাবে। সিলেটে একটি থাকার পর আরেকটি হচ্ছে। কিন্ত নমুনা নিয়ে ৪ জেলার স্বাস্থ্য বিভাগকে ঠিকই দৌড়াতে হবে সেখানে। আনিছুর রহমান বলেছেন শুধু দুটিই নয় সিলেট কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে আরেকটি ল্যাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কৌশলগত সুবিধা এবং অধিক নমুনা থাকার পর হবিগঞ্জকে বাদ দিয়ে কেন শুধু সিলেটে হচ্ছে সেটি আমার বোধগম্য হচ্ছে না। হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান আমাকে বলেছেন হবিগঞ্জে সবছেয়ে বেশী নমুনা প্রেরণ করা হয়। আমরা হবিগঞ্জে একটি ল্যাব প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করেছি। এখানে ল্যাব থাকলে এই সমস্যা হত না। কিন্তু সেই সুপারিশে কেন কাজ হচ্ছে না তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আসুন আমরা সবাই মিলে হবিগঞ্জে ল্যাব প্রতিষ্ঠার জন্য জনমত গড়ে তুলি। আর না হলে আমাদের হবিগঞ্জবাসীকে বড় মাসুল দিতে হবে।
লেখক
সংবাকর্মী ও আইনজীবী
Leave a Reply