,

আফিয়ার খুনি কে- হবিগঞ্জের মুন্নি না নিয়াজ?

জুয়েল চৌধুরী : সিলেট মহানগরীর উত্তর বালুচরের সোনার বাংলা আবাসিক এলাকায় আফিয়া বেগম সামিহা (৩১) নামের গৃহবধূ খুনের ঘটনায় এক নারী ও এক পুরুষকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের বাসিন্দা মোছা. মাজেদা খাতুন মুন্নি (২৯) নামের এক নারীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-৯। তারা বলছে-ওই নারী আফিয়াকে খুন করেছেন।
অপরদিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে খুন হওয়া আফিয়ার কথিত স্বামী ইসমাইল নিয়াজ খানকে। গ্রেফতারের পর তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। পরে আদালত ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। পুলিশের দাবি- কথিত স্ত্রী আফিয়া হত্যায় তার হাত রয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাদ করলে অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যাবে।
মঙ্গলবার দিবাগত (২৪ আগস্ট) রাত সাড়ে ১২টার দিকে সিলেট মহানগরীর উত্তর বালুচরের সোনার বাংলা আবাসিক এলাকার সেকান্দর মহল নামক (৩৬৪ নং) পাঁচতলা বাসার নিচতলার একটি ইউনিটের ভাড়াটে আফিয়া বেগম সামিহার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় মৃতদেহের পাশেই অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় আফিয়ার ১৪ মাস বয়েসি শিশুকন্যা নুরিকে।
আফিয়া বেগম সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার জাঙ্গাইল তুয়াকুল গ্রামের আজির উদ্দিনের মেয়ে। আফিয়ার মৃত্যুর পর এ নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ-এটি একটি হত্যাকাণ্ড। আর এতে আফিয়ার স্বামী জড়িত। আফিয়ার স্বামীর নাম নিয়াজ উদ্দিন। তিনি ওমানে ছিলেন। সম্প্রতি তিনি দেশে ফেরেন এবং আফিয়ার দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেফতারের পর জেলও খাটেন। ৮ দিন আগে তিনি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হন। এরপর থেকে আফিয়ার স্বামীর কোনো খোঁজ মিলছে না। নিজাম সম্পর্কে আফিয়ার বাবার পরিবারের সদস্যরা আর কোনো তথ্য দিতে পারছে না। এমনকি তার পূর্ণ ঠিকানাও বলতে পারছে না।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, সেকান্দর মহলের নিচতলার ওই ইউনিটটি প্রায় দুই বছর আগে ভাড়া আফিয়া বেগম। এরপর থেকে তিনি তার শিশুকন্যা নিয়ে একাই ওখানে থাকতেন। গত ১৮ আগস্ট থেকে প্রতিবেশিরা আফিয়াকে দেখতে পাননি। মঙ্গলবার রাতে তার ঘরের ভেতর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। এতে পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সন্দেহ হয় এবং দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে তারা দেখতে পান- আফিয়ার ইউনিটের দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। এরপর তারা পুলিশে খবর দেন।
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দরজার তালা ভেঙে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে আফিয়ার মরদেহ খাটের পড়ে থাকতে দেখে। মরদেহ থেকে উৎকট দুর্গন্ধ বের হচ্ছিলো। মৃতদেহের পাশেই অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় আফিয়ার শিশুকন্যা নুরিকে। তখন পুলিশ শিশুটির শ্বাস-প্রশ্বাস চলতে দেখে দ্রুত তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। শিশুটি এখন সুস্থ আছে।
এদিকে, আফিয়ার মৃত্যুর এ নিয়ে রহস্যজট সৃষ্টি হয়। তার বাবা, ভাই ও বড় বোন জানান- তাদের পরিবার হতদরিদ্র। আফিয়াকে বেশ কয়েক বছর আগে সিলেট মহানগরীতে এক নারী চিকিৎসকের বাসায় কাজ করার জন্য দেন। ওই নারী চিকিৎসক প্রায় ১০ বছর আগে আফিয়াকে নিয়াজের সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের কয়েক বছর পর নিয়াজ প্রবাসে চলে যান। গত দুবছর আগে তিনি দেশে ফিরলে পরিবাারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আফিয়ার সঙ্গে কলহের সৃষ্টি হয়। এসময় আফিয়ার বাবার বাড়িতে এ বিষয়ে বিচারসালিশও হয়। পরে বিষয়টি আর সমাধানের পথে যায়নি এবং নিয়াজ ফের ওমানে চলে যান।
আফিয়ার বাবার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ- নিয়াজ কয়েক বছর ধরে আফিয়া ও তার সন্তানের ভরণ-পোষণ করছেন না। বিষয়টি নিয়ে আফিয়া স্বামীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করেন। কিছুদিন আগে নিয়াজ দেশে ফিরলে এ মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। ৮ দিন আগে জামিন নিয়ে নিয়াজ কারাগার থেকে বের হন। এরপর থেকে তিনি লাপাত্তা।
আফিয়া হত্যার ঘটনায় বুধবার তার মা কুটিনা বেগম বাদী হয়ে শাহপরাণ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। এরপর বুধবার (২৪ আগস্ট) রাতে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বড়ইকান্দি এলাকা থেকে নিয়াজকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
নিয়াজের বিষয়ে শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ আনিসুর রহমান বলেন- ইসমাইল নিয়াজ খানকে বৃহস্পতিবার বিকেলে সিলেট মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পাঁচদিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। পরে বিচারক তার চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়েছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মুন্নি নামে একজন নারী জড়িত। যাকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে। তিনি ঘটনার দিন বালুচরের ওই বাসায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে পালিয়ে যান। বিষয়টি আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হয়েছি। মুন্নির সঙ্গে ইসমাইল নিয়াজ খানের একটা যোগসূত্র রয়েছে। আশা করছি, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হবে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টার দিকে প্রেস ব্রিফিং করে র‌্যাব-৯ জানায়, আফিয়াকে খুন করেছেন মোছা. মাজেদা খাতুন মুন্নি নামের ওই নারী। পাওনা টাকার দ্বন্দ্বে এ খুনের ঘটনা ঘটেছে।
র‌্যাব-৯ এর মিডিয়া অফিসার এএসপি আহসান-আল-আলিম জানান, আফিয়া হত্যার ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে মামলা দায়েরের পর এর সূত্র ধরে রহস্য উদঘাটনে র‌্যাব-৯-ও গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করে । তদন্তের এক পর্যায়ে আফিয়া হত্যাকাণ্ডে মাজেদা জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। পরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-৯ আভিযান চালিয়ে মুন্নিকে বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) ভোরে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। মুন্নি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার সারংপুর গ্রামের আব্দুল গনির মেয়ে।
র‌্যাবকে জানায়, মাজেদাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা জানতে পেরেছে- আফিয়ার সঙ্গে তার টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে তার দ্বন্দ্ব ছিলো। আফিয়ার বাসায় মাজেদা সাবলেট থাকতাে। কিন্তু বেশিরভাগ দিন মাজেদা বাসায় অবস্থান করতো না। আফিয়ার নিকট মাজেদা বিভিন্ন সময় টাকা-পয়সা গচ্ছিত রাখতাে। একপর্যায়ে মাজেদার পাওনা টাকা আফিয়া দিতে অস্বীকার করে। ফলে আফিয়ার উপর ক্ষিপ্ত হয় মাজেদা এবং আফিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
ঘটনার দুইদিন আগে (১৮ আগস্ট) আফিয়ার বাসায় আসে মাজেদা। ঘটনার দিন (২০ আগস্ট) রাত ১০টার দিকে আফিয়া ও মাজেদার মধ্যে পাওনা টাকা নিয়ে ঝগড়া হয়। পরে ২১ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টার দিকে অকস্মাৎ মাজেদা রান্নাঘর থেকে শীল (পটার শীল) নিয়ে এসে আফিয়ার মাথার বাম পাশে সজোরে পরপর ২টি আঘাত করে।
আঘাতের ফলে তৎক্ষণাৎ আফিয়া বিছানায় লুটিয়ে পড়ে। পরে ভাের আনুমানিক ৬টার দিকে মাজেদা ওই বাসা থেকে বের হয়ে একটি রিকশা ভাড়া করে নিয়ে আসে এবং বাসার দরজা বাহির থেকে তালা মেরে সে তার মালামাল ও আফিয়ার মােবাইল ফোন নিয়ে বানিয়াচংয়ে নিজ বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু এ ঘটনায় আশ্চর্যজনকভাবে বাসায় আটকা পড়া আফিয়ার শিশুকন্যা বেঁচে যায়। পরে তাকে পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃত মাজেদাকে শাহপরাণ থানায় হস্তান্তর করেছে র‌্যাব-৯।


     এই বিভাগের আরো খবর