,

‘কায়সার বাহিনী’র প্রধান সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ কায়সারের ফাঁসি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধ সংগঠনকারী হবিগঞ্জ মহকুমার এ রাজাকার কমান্ডারের বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, মুক্তিপণ আদায়, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন এবং ষড়যন্ত্রের ১৪টিই প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সর্বোচ্চ এ দন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে কোনো যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দন্ডাদেশ দিলেন ট্রাইব্যুনাল। কায়সারের বিরুদ্ধে দুই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সাঁওতাল নারী হীরামনি ও মাজেদা নামের অপর নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ দু’টি প্রমাণিত হয়েছে রায়ে। ওই দুই বীরাঙ্গনা নারী ও ধর্ষণের ফলে বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহার ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্যও দেন কায়সারের বিরুদ্ধে। রক্ষায়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত বীরাঙ্গনা নারী ও যুদ্ধশিশুদের ক্ষতিপূরণ স্কিম চালুর পাশাপাশি তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে বলেছেন ট্রাইব্যুনাল। গতকাল মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) সকালে এ রায় ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। কায়সারের বিরুদ্ধে ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন’১৯৭৩ এর ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(আই), ২০ (২) এবং ৪(১) ধারা অনুসারে আনা এসব অভিযোগের মধ্যে ছিল ১৫২ জনকে হত্যা-গণহত্যা, ২ নারীকে ধর্ষণ, ৫ জনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় এবং দুই শতাধিক বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের অভিযোগ। এগুলোর মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে ৪ ও ১৫ নম্বর বাদে সবগুলো অভিযোগ। প্রমাণিত ১৪ অভিযোগের মধ্যে ৭টিতে অর্থাৎ ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, ১২ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির আদেশ পেয়েছেন কায়সার। ৪টি অর্থাৎ ১, ৯, ১৩ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে তাকে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদন্ডাদেশ। এছাড়া ২নম্বর অভিযোগে ১০ বছর, ৭নম্বর অভিযোগে ৭বছর এবং ১১নম্বর অভিযোগে ৫ বছর মিলিয়ে আরও ২২বছরের কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে। প্রমাণিত না হওয়া ৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন কায়সার। ঘৃণিত বাহিনী ও ব্যক্তি; রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একাত্তরে সৈয়দ কায়সার প্রথমে হবিগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৫০০/৭০০ স্বাধীনতাবিরোধী লোক নিয়ে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ নামে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করার জন্য একটি সহযোগী বাহিনী গঠন করেন। তিনি নিজে ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ‘কায়সার বাহিনী’ নামাঙ্কিত এ বাহিনীর নিজস্ব ইউনিফরমও ছিল। কায়সার এ বাহিনীর মাধ্যমে তিনি হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লায় হত্যা, গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ধর্ষণ, হামলা, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালান। রায়ের পর্যবেক্ষণে কায়সার বাহিনীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী বা অক্সিলারি ফোর্স না বললেও ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ বাহিনী ও সৈয়দ কায়সার ভিক্টিম ও অপরাধ সংঘটনস্থল এলাকাগুলোর মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকবে। বীরাঙ্গনা-যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসন করতে হবে রায়ের পর্যবেক্ষণে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত বীরাঙ্গনা নারী ও যুদ্ধশিশুদের ক্ষতিপূরণ স্কিম চালু করার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে বলেছেন ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য বলেন ট্রাইব্যুনাল। এক্ষেত্রে সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং এনজিওগুলোকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বলেছেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল তাদেরকে আমাদের দেশের জাতীয় বীর বলেও উল্লেখ করেন। প্রসিকিউশন কায়সারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এ তিনজনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। কায়সারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি না পাওয়া গেলে রাষ্ট্র তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেবে বলেও দাবি করেন প্রসিকিউশন। প্রমাণিত হওয়া সাতটি অভিযোগে কায়সারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে প্রমাণিত তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টা থেকে সোয়া ৭টার দিকে হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) মাধবপুর থানার কৃষ্ণনগর গ্রামের অহিদ হোসেন পাঠান, চেরাগ আলী, জনাব আলী ও মধু সুইপারকে হত্যা এবং তাদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট করার পর অগ্নিসংযোগ করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। প্রমাণিত পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৩টা থেকে ৪টা এবং সন্ধ্যার পর যেকোনো সময় হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) সদর থানার পুনারবাজার পয়েন্ট, সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ.বি.এম মহিউদ্দিনের বাড়ি ও লস্করপুর রেললাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ডা. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং হীরেন্দ্র চন্দ্র রায়কে ধরে নিয়ে আটকের পর নির্যাতন করে হত্যা করে সৈয়দ কায়সার এবং তার বাহিনী। প্রমাণিত ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল সকাল আনুমানিক ১০টা সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৪টা সাড়ে চারটার মধ্যে হবিগঞ্জ জেলা (তৎকালীন মহকুমা) সদরের এনএনএ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ ৪০/৫০টি বাড়ি-ঘর ও দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরো খবর
×

Like us on Facebook

Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.