,

সৌদিতে নির্যাতনের শিকার হয়ে অসুস্থ্য অবস্থায় দেশে ফিরেছে নবীগঞ্জের রাবিয়া

“প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়ে রাবেয়া মানসিকভাবে অসুস্থ, তাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন”

মতিউর রহমান মুন্না : পরিবারের স্বচ্ছলতার আশায় বিদেশে কাজে গিয়ে প্রতিনিয়তই শারীরিক-মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্চেন অনেক নারী শ্রমিক। বছরে গড়ে তিন থেকে চার হাজার নারী ফিরতে বাধ্য হন। প্রবাস ফেরত এসব নারীদের মুখে নির্যাতনের ভয়ংকর বর্ণনা শুনে আতঙ্ক জাগে মনে। নির্যাতিত যেসব নারী পালিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের শরীরেও নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট রয়েছে। যদিও অনেকেই দেশে ফিরে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খুলেন না। সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে নিয়োগকর্তার নির্যাতনে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার রাবিয়া খাতুন (৩৮)। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ রাবিয়া দেশে ফেরার পর পরিবারকে খুঁজে পাওয়া দুস্কর হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে গণমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয়দের সহায়তায় পরিবারের কাছে রাবিয়া খাতুনকে হস্তান্তর করেছে ব্র্যাক লার্নিং সেন্টার।
শনিবার (৬ এপ্রিল) বিকেলে সৌদি ফেরত রাবিয়া খাতুন (৩৮)-কে নিয়ে নবীগঞ্জ উপজেলার সদরাবাদ গ্রামে নিজ বাড়িতে ফেরে তার পরিবার। রাবিয়া খাতুন নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউনিয়নের সদরাবাদ গ্রামের নবির হোসেনের মেয়ে ও কাজল উল্লাহর স্ত্রী।
রাবিয়া খাতুনের পরিবার ও ব্র্যাক সূত্রে জানা যায়- পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে ২০২২ সালে রিক্রুটিং এজেন্সি দ্য ইফতি ওভারসিজ (আরএল-৮৯৪) মাধ্যমে সৌদি আরবে গৃহপরিচারিকার ভিসায় পাড়ি জমান রাবিয়া খাতুন। সেখানে যাওয়ার পর রাবিয়া খাতুনের জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ নির্যাতন। প্রতিনিয়ত নিয়োগকর্তার নির্যাতনে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাবিয়া। বন্ধ হয়ে যায় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ। বুধবার (৩ এপ্রিল) রাতে সৌদি আরব থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশে ফেরেন রাবিয়া খাতুন। রাতে বিমানবন্দরের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছিলেন রাবিয়া।
বৃহস্পতিবার সকালে রাবিয়াকে ক্যানপিতে লক্ষ্যহীন চলাফেরা করতে দেখে এপিবিএন সদস্যরা তাদের অফিসে নিয়ে যান। তবে তার কাছে কারও মোবাইল নম্বর বা কোনো তথ্য না থাকায় পরিবার খুঁজে নিরাপদে হস্তান্তরের জন্য এপিবিএন সদস্যরা তাকে ঢাকার আশকোনার ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে পাঠান।
রাবিয়ার পরিবারের সন্ধান পেতে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ম্যানেজার মো. আল আমিন নয়ন গণমাধ্যমকর্মীদের সহায়তা চান। পরে হবিগঞ্জের স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী-জনপ্রতিনিধিদের ও সচেতন কিছু যুবকের প্রচেষ্ঠার ফলে রাবিয়া খাতুনের পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়। ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ম্যানেজার মো. আল আমিন নয়নের সঙ্গে যোগাযোগ হয় রাবিয়া খাতুনের পরিবারের। মায়ের সন্ধান পেয়ে শুক্রবার (৫ এপ্রিল) রাতেই রাবিয়া খাতুনের মেয়ে তাছলিমা আক্তার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। শনিবার (৬ এপ্রিল) সকালে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের কর্মকর্তারা রাবিয়া খাতুনকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। শনিবার বিকেলে সৌদি ফেরত রাবিয়া খাতুন (৩৮)-কে নিয়ে নবীগঞ্জ উপজেলার সদরাবাদ গ্রামে নিজ বাড়িতে ফেরে তার পরিবার।
রাবিয়া খাতুনের স্বামী কাজল উল্লাহ বলেন- আমার স্ত্রী সৌদি আরব যাওয়ার পর মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হয়েছিল, যাওয়ার পর থেকে তার উপর নানাভাবে নির্যাতন করে নিয়োগকর্তা। বিগত ১ মাস ধরে আমার স্ত্রী রাবিয়াকে ফোনে পাওয়া যাচ্চিলনা, আমরা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম, শুক্রবার সন্ধ্যায় স্থানীয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে খবর পেলাম আমার স্ত্রী দেশে এসেছে, ঢাকায় ব্র্যাক সেন্টারে আছে। পরে আমার মেয়ে ঢাকায় গিয়ে আমার স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। তিনি জানান- রাবিয়া প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে, তার চিকিৎসা প্রয়োজন। কাজল উল্লাহ তাঁর স্ত্রীর উপর ঘটে যাওয়া অমানুষিক নির্যাতনের বিচার দাবী করে নারীদের প্রবাসে পাড়ি জমাতে সতর্ক হওয়ার অনুরোধ জানান।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ম্যানেজার মো. আল আমিন নয়ন বলেন, ‘রাবিয়া আমাদের বলেছেন, তিনি সৌদিতে নিয়োগকর্তার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বর্তমানে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ্য। তাই তাকে একা বাড়ি পাঠাতে পারিনি। গণমাধ্যমকর্মীদের সহায়তায় তার পরিবারের সন্ধান পাই । পরে শনিবার রাবিয়ার পরিবারের কাছে রাবিয়াকে হস্তান্তর করি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের রয়েছে আলাদা অভিবাসন কর্মসূচি। প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ৭১৪ নারী শ্রমিকের লাশ এসেছে দেশে। যার মধ্যে ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যুর সনদ লেখা লাশের সংখ্যা ২৬২। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে সৌদি আরব, জর্দান, লেবানন ও ওমানে। এই সময়ে মারা গিয়েছেন সৌদি আরবে ২০২ জন, জর্দানে ৯৬ জন, লেবাননে ৭৮ জন ও ওমানে ৫৮ জন। সালের হিসেবে ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মৃত্যু ঘটেছিল ২০২৯ সালে, ১৩৯ জন। এ ছাড়াও ২০১৬ সালে ৫২ জন, ২০১৭ সালে ৯৪, ২০১৮ সালে ১১০, ২০১৯ সালে ১৩৯, ২০২০ সালে ৮০, ২০২১ সালে ১২২ এবং ২০২২ সালে ১১৭ জন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৩৭ শতাংশ ছিল স্বাভাবিক মৃত্যু। এ ছাড়াও মস্তিষ্কে রক্তরণজনিত ১৯ শতাংশ, আত্মহত্যা ১৬, দুর্ঘটনা ১৫ এবং অন্যান্য কারণে ১৩ শতাংশ নারীশ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। বছরে গড়ে তিন থেকে চার হাজার নারী ফিরতে বাধ্য হন। ১৯৯১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১২ লাখ নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন। অতিরিক্ত কাজের চাপ, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের কারণে দেশে ফিরে আসেন তাদের অনেকেই। বিদেশে নির্যাতনের কারনে মারা যান অনেক নারী কর্মী। মৃত নারীশ্রমিকের পরিবারের সদস্যসহ অভিবাসন-বিশেষজ্ঞরা মৃত্যুর এই কারণ বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন।


     এই বিভাগের আরো খবর