,

এক নারীর অভিনব প্রতারণার শিকার হবিগঞ্জের অসংখ্য তরুণ-তরুণী :: চাকরি এবং ভাতা দেয়াসহ নানা কৌশলে হাতিয়ে নিতেন টাকা

অভিযোগ : কক্সবাজার থেকে ৩০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি

জাবেদ তালুকদার : নাহিদা ঝুমুর আজাদ প্রকাশ সাদিয়া আফরিন সারিন নামে এক নারীর অভিনব প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন হবিগঞ্জের অসংখ্য তরুণ-তরুণী। চাকরি দেয়া এবং ভাতা দেয়াসহ আরো বিভিন্ন কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। তার মূল টার্গেট ছিল হবিগঞ্জের নারী উদ্যোক্তারা। ফেইসবুক গ্রুপ খুলে উদ্যোক্তাদের সাথে সখ্যতা করে ধার নেয়ার নাম করে এবং বাকীতে পণ্য নিয়েও হাতিয়ে নিয়েছেন লক্ষাধিক টাকা। এমন অভিনব প্রতারণার অভিযোগ উঠলেও তা মানতে নারাজ অভিযুক্ত নাহিদা ঝুমুর আজাদ। তার ভাষ্য তিনি তাদের উপকারের জন্য টাকা নিয়েছিলেন, কাজ হয়নি টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন। প্রায় ৬ মাস ধরে তার অভিনব এ প্রতারণা চললেও এ বিষয়ে কোন তথ্য নেই আইন শৃংখলা বাহিনীর কাছে।
তার প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়া অন্তত ১০ জন ভূক্তভোগী এবং প্রায় অর্ধশতাধিক নারী উদ্যোক্তারসাথে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। তারা প্রত্যেকেই নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে খুলে বলেছেন তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অভিনব প্রতারণার গল্প। নাম প্রকাশ এবং প্রতারণার বিষয়ে কোন অভিযোগ না করার কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, যা হয়ে গেছে, শেষ। আমরা আর কোন ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চাইনা।
জানা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ‘আমরাই নারী আমরাই উদ্যোক্তা’ নামে একটি ফেইসবুক গ্রুপ খুলেন সাদিয়া আফরিন সারিন। নারী উদ্যোক্তাদের বিজনেস প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাড় করান এই গ্রুপকে। শুরুতে ভালোই চলছিলো গ্রুপের কার্যক্রম। হবিগঞ্জের নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে মিট আপসহ বিভিন্ন প্রোগ্রাম করেন। ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় তাদের পাশে থাকতে গ্রহণ করা তার নানা উদ্যোগ। নারী উদ্যোক্তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠার পর সেই গ্রুপকে ব্যবহার করে ‘রেজিস্ট্রেশন ফি’ এর নামে শুরু করেন চাদাবাজি। আড়াই হাজার টাকা ‘রেজিস্ট্রেশন ফি’ দিলে গ্রুপে মডারেটরের চাকরি এবং গ্রুপ থেকে সেলারিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা হবে বলে জানান তিনি। বাড়তি সুবিধা নিতে এবং সেলারীর আশায় ১৮ জন নারী উদ্যোক্তা গ্রুপে রেজিস্ট্রেশন করেন। শুরুতে দুয়েক মাস বেশ কয়েকজনকে সেলারী দেয়া হয়। এরপর সবার সেলারী বন্ধ করে আবারও নতুন সদস্যদের থেকে গ্রুপে ’রেজিস্ট্রেশন ফি’ নামে চাদাবাজী শুরু করেন। এরই মাঝে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি দেয়ার প্রলোভনে বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লক্ষাধিক টাকা। গ্রুপের সুবাধে উদ্যোক্তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠার পর বিভিন্ন সময় তাদের থেকে টাকা ধার চাইতেন এবং পণ্য নিয়ে টাকা দিতেন না।
গ্রুপের একাধিক নারী উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, শুরুতে তাকে ভালো মনে হলেও আস্তে আস্তে তার মুখোশ খুলতে থাকে। প্রায় ২ মাস ধরে আমাদের পাওনা টাকা দেয়ার তারিখ করলেও নানা অজুহাতে এড়িয়ে যাচ্ছেন তাদেরকে। সর্বশেষ গত ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় প্রত্যেকের বিকাশে টাকা দেয়ার কথা হলে সেদিন সন্ধ্যায় মে মাসের ২ তরিখে টাকা দেয়া হবে বলে জানান তিনি। মে মাসের ২ তারিখ পেরিয়ে গেলেও কাউকে টাকা দেয়ার কোন খবর পাওয়া যায়নি।
গ্রুপের পরিচিত সকল উদ্যোক্তার থেকে টাকা চাওয়া, টাকা না দিয়ে পণ্য নেওয়া এবং অনেকের কাছ থেকেই রেজিস্ট্রেশন ফির নামে টাকা নেয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে তাকে নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয় উদ্যোক্তাদের। এ বিষয়ে প্রতিবেদকের কাছে তথ্য এলে সাদিয়া আফরিন সারিনের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য। ফেইসবুক আইডি অনুযায়ী তার নাম সাদিয়া আফরিন সারিন হলেও জাতীয় পরিচয়পত্র বলছে তার নাম নাহিদা ঝুমুর আজাদ। তবে তার মূল নাম জানেন না অনেকেই, উদ্যোক্তারা তাকে সাদিয়া আফরিন সারিন নামেই চিনেন।
জানা গেছে, ২০২১ইং সনে কক্সবাজার এনজিওতে চাকরী দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অসংখ্য তরুন তরুণীর থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা আত্মসাত করে পালিয়ে আসেন তিনি ও তার পরিবার। নিজের মেইল থেকে ভুয়া নিয়োগ পত্র এবং কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন উর্ধতন কর্মকর্তাদের নাম এবং আইডি ব্যবহার করে কাগজ পত্র সরবরাহ করে চাকরী দেওয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। তিনি এবং তার স্বামী বলতেন তাদের সাথে ক্যাম্পের বিভিন্ন সিআইসি বা সচিবদের সাথে যোগাযোগ আছে। তারা চাইলে যে কাউকে চাকরী দিতে পারে। সে জন্য তাদের টাকা দিতে হবে। একজনকে তারা মেইল আইডিতে নিয়োগ পত্রও পাঠিয়েছে, সেখানে তার বেতন ধরা হয়েছে প্রতি মাসে ৭৫ হাজার টাকা। সেটা বিশ^াস করে তিনি ২ লাখ টাকা দেন। তাও প্রতিবেশী থেকে ধার নিয়ে যা তার পরিবারও জানেনা। পরে তিনি দেখেন সব কিছু ছিল ভুয়া, তারা অনেকের কাছ থেকে এভাবে টাকা নিয়েছে।
এ ঘটনার কক্সবাজার সদর থানায় ঝুমিরা নাহিদা আজাদ প্রকাশ সাদিয়া আফরিন সারিন ও তার স্বামী তৌহিদুল ইসলাম তৌহিদসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভোক্তভোগীরা। এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর থানায় যোগাযোগ করা হলে থানার ওসি বলেন, ২০২১ইং সনে আমি এ থানায় ছিলাম না। এতো আগের ঘটনা আমি জানি না।
হবিগঞ্জে বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং বিধবা ভাতা দেয়ার নাম করেও তিনি হাতিয়ে নিতেন টাকা। এক প্রতিবন্ধী মেয়েকে ভাতা দেয়ার নামে তার মায়ের থেকে আড়াই হাজার টাকা, এক বিধবা মহিলাকে ভাতা দেয়ার নাম করে আড়াই হাজার টাকা এবং এক মহিলাকে বয়স্ক ভাতা দেয়ার নাম করে আড়াই হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি তার গ্রুপে দেয়া এক ফেইসবুক পোস্ট থেকে বুঝা যায় ভাতা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের সাথে তিনি জড়িত।
গত এপ্রিলে তার বাসা ডাকাতি হয়েছে মর্মে তার ফেইসবুক গ্রুপে কান্নাকাটি করে একটি লাইভ করেন তিনি। এ বিষয়ে খোজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে আরো বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছে, বাসা ডাকাতি নয় পাওনাদাররা তাকে না পেয়ে বাসার আসবাবপত্রসহ কিছু জিনিস নিয়ে গেছে।
তাকে নিয়ে এক নারী উদ্যোক্তা বলেন, যখন তিনি ফেইসবুক গ্রুপ খুলে চাদাবাজী শুরু করেন তখন থেকেই তাকে নিয়ে আমাদের সন্দেহ হচ্ছিলো। বেশ কয়েকজনকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি।
আরেক নারী উদ্যোক্তার থেকে শুনা যায়, হঠাৎ তিনি তার বাসায় কেক পাঠান, কেক দেখে অবাক হয়ে যান তিনি। এর কিছুদিন পরই তিনি উদ্যোক্তার কাছে টাকা ধার চান। পরে জানা যায় অনেকের সাথেই তিনি সখ্যতা গড়ে এভাবে টাকা ধার চান।
আরেকজন বলেন, ফেইসবুক গ্রুপের সুবাধে তার সাথে পরিচয় হলে তিনি আমার কাছে ৭-৮ হাজার টাকা ধার চান। টাকা নেই বলে এড়িয়ে যাই।
এক ভূক্তভোগী বলেন, তার সাথে হবিগঞ্জের বেশ কয়েকজন পরিচিত মুখকে দেখে সহজেই বিশ^াস করে ফেলি। পরে বুঝতে পারলাম তিনি আসলে একজন প্রতারক।
এ বিষয়ে হবিগঞ্জ সদর থানার ওসি অজয় চন্দ্র দেবের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোন তথ্য বা অভিযোগ নেই।


     এই বিভাগের আরো খবর