,

ভাষার জন্য ভালোবাসা

সময় ডেস্ক: ওরা সবাই তরুণ প্রাণ। ভাষাকে ভালোবেসে ওরা নেমেছে বানান শুদ্ধি অভিযানে। পরিচিত হোন এ সময়ের তরুণদের অনন্য এক উদ্যোগের সঙ্গে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন সজীব মিয়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাকতাড়–য়ারার সদস্যরা। ছবি: আনিস মাহমুদসিলেট শহরের অলিগলি থেকে শহরতলি— তাঁদের উপস্থিতি সবখানেই। রংতুলি হাতে তাঁরা চষে বেড়ান এলাকার দোকানপাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ফটকে ফটকে। সাইনবোর্ড কিংবা বিলবোর্ড-যেখানেই চোখে পড়ে ভুল বাংলা বানান, সেখানেই চলে তাঁদের শুদ্ধি অভিযান। এই শুদ্ধ বাংলাচর্চার কাজটি করে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাকতাড়–য়ার সদস্যরা। সংগঠনের নাম কাকতাড়–য়া কেন? জিজ্ঞেস করতেই সংগঠনের অন্যতম সদস্য ফয়সাল খলিলুর রহমান বলেন, ‘বাস্তবের কাকতাড়–য়া যেমন ফসলের খেত থেকে কাক তাড়–য়ার, আমরা সমাজ থেকে নানা অসংগতি দূর করতে কাজ করি। শ্রদ্ধাঞ্জলিটুকু যেন হয় শুদ্ধ ভাষায?বানান শুদ্ধি অভিযান কাকতাড়–য়া বানান শুদ্ধির এই যাত্রা শুরু করে গত বছরের একুশে ফেব্রুরিতে। বাংলা বানান শুদ্ধি অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী গোলাম সারোয়ার জানান, ‘আমরা ইতিমধ্যে ১৩৭টি প্রতিষ্ঠানে বানান শুদ্ধির জন্য হাজির হয়েছি। এর মধ্যে ১১৬টি প্রতিষ্ঠানে বানান শুদ্ধ করতে পেরেছি। বাকিরা নিজেদের উদ্যোগে অচিরেই ভুল বানানগুলো শুদ্ধ করে নেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। শুধু ফয়সাল বা সারোয়ারই নন, এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন অভিজিৎ পাল, ফাতেমা তুজ জোহরা, আজিম হোসেন, মেমিতা, তানজিয়া বিনতে হাই, হজরত আলী, রাসেল আহমেদ, বনানী ভট্টাচার্য, লুৎফুন্নাহার, রবিউল ইসলাম, মোছাম্মৎ নুসরাত, জহির রায়হান, তানজিলা , সুমাইয়া রশীদ, উপমা দেবনাথ, রিতা আক্তার, আহমেদ আল মিনহাজ, প্রবাল দত্ত, সাকিন উল আলম, মাহির চৌধুরী, এ এইচ সুমন, নিশাত তানজুমসহ আরও অনেক তরুণ। তাঁরা সবাই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, এমসি কলেজসহ সিলেটের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। ষ্টোর’ নয় স্টোর!একুশে ফেব্রুয়ারির পর প্রতি মাসেই কাকতাড়–য়ার সদস্যরা ঘুরে বেড়িয়েছেন সিলেট শহরের অলিগলিতে। কাকতাড়–য়া বাংলা ভুল বানান শুদ্ধ করেই বসে থাকেনি, পরবর্তী সময়ে একই ভুল যাতে অন্যরা না করে, সে ব্যাপারেও সচেতনতা তৈরির কাজটুকুও নিয়েছে নিজেদের কাঁধে। এ জন্য বানান শুদ্ধ করার পাশাপাশি সঠিক বানান লিখতে প্রচারণা চালিয়েছে বিভিন্ন ছাপাখানা ও ব্যানার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে। ভুল বানানে রংতুলির আঁচড় এই কাজ করতে গিয়ে অভিজ্ঞতাও কম হয়নি তাঁদের। বিনয?ের সঙ্গে দোকানিকে যখনই বলতে গিয়েছেন, ‘ভাই, আপনার দোকানের সামনে এই বাংলা বানানটি ভুল, আমরা রং-তুলি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। অনুমতি দিলে বানানটি ঠিক করতে চাই।’ কথা শুনে কেউবা ‘বিদায় হও’ বলে তেড়ে এসেছে, আবার অনেকে সম্বোধন করেছে ‘পাগলের দল’ বলে। তবে এর বিপরীত ঘটনা কম না। অনেকে কৌতূহলমিশ্রিত হাসিতে জিজ্ঞেস করে কুশলাদি, কেউবা টুল এগিয়ে দিয়েছে বসার জন্য, কেউ আবার করিয়েছে আপ্যায়ন। ‘শুধু তা-ই নয়, একদিন তো আমরা প্রচারণার কাজ শেষ করে শহরে আসার গাড়ি পাচ্ছিলাম না। সবাই যখন সিদ্ধান্ত নিলাম হেঁটে এগিয়ে যাওয়ার, তখনই এক ট্রাকচালক এসে হাজির আমাদের শহর অবধি পৌঁছে দেওয?ার জন্য। তিনি অনেকক্ষণ ধরে নাকি আমাদের কার্যক্রম দেখেছিলেন, যোগ করেন সদস্য নুসরাত ফারাহ। নুসরাতের মতো সবাই তখন বলতে শুরু করে এমন বহু গল্প। কথা এগোতে থাকে কাকতাড়–য়াদের সঙ্গে। এর ফাঁকেই আসল কথাটি বলেন আরেক সদস্য সুনন্দা দত্ত, ‘ভুল দেখতে দেখতে একসময় ভুলটাকেই আমরা শুদ্ধ বলে ধরে নেব। আমরা চাই বাংলাদেশের সব জায়গায় বানান শুদ্ধি অভিযান শুরু হোক।‘দ’ আর ‘ধ’-এর মধ্যে অনেক ফারাক!কাকতাড়–য়ার কার্যক্রম নিয়ে সিলেট কমার্স কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাক আহমাদ দীন বলেন, ‘সিলেট নগরে চলতে-ফিরতে প্রায়ই নানা দোকান, রেস্তোরাঁ ও প্রতিষ্ঠানের ভুল বানানে লেখা নাম চোখে পড়ি। এটি দৃষ্টিকটু ও লজ্জার। নগরের পাড়া-মহল্লার অধিকাংশ সামাজিক সংগঠনের ভুল নামও আমাদের বিব্রত করে। এ অবস্থায় উদ্যমী তরুণদের বানানপ্রীতির এ কর্মসূচি খুবই আশার সঞ্চার করে। এটি এককথায় শুদ্ধ বানানপ্রীতির একটি উদ্যোগ। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানের ভুল বানানগুলো তাঁরা শুধরিয়ে দেবেন, সেটি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের সঙ্গে নিয়ে করলে আরও কার্যকর হবে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন ভূঁইঞা বলেন, বানান বিষয়ে অনেকের কোনো সতর্কতা নেই। এই তরুণেরা সিলেটের অনেকের চোখ খুলে দিচ্ছে।’
সহযোগিতা: উজ্জল মেহেদী

দেয?াললিখনেও চলছে শুদ্ধি অভিযানএগিয?ে এসেছেন আরও তরুণ

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায? ‘শুদ্ধ লিখি’ শিরোনামে কর্মসূচি পরিচালনা করছে ওয?ান ডিগ্রি ইনিশিয?েটিভ নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ওয?ান ডিগ্রি ইনিশিয?েটিভের এই উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শামিল হয?েছে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয?ের শিক্ষার্থীরা। অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের দক্ষ করে তুলতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আয?োজন করা হয?েছিল কর্মশালার।

এই উদ্যোগ নিয?ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও ছিল তাদের প্রচারণা। কর্মসূচি উপলক্ষে খোলা ফেসবুক ইভেন্টে বিভিন্ন এলাকা থেকে ভুল বানানের ছবি আহ্বান করা হয?েছে। এসব ছবি দেখে আবার সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে শুদ্ধ লিখির স্বেচ্ছাসেবকেরা। এরই মধ্যে শুদ্ধ লিখির স্বেচ্ছাসেবকেরা হাজির হয?েছেন রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান থেকে আবাসিক এলাকা, রাজপথ থেকে মহল্লার অলিগলিতে। শুদ্ধ লিখি কর্মসূচির পরিচালক শায?ান তাসওয?ার জানান, ‘আমরা এ পর্যন্ত প্রায? ৬০০ শব্দ শুদ্ধ করেছি। এ কাজ করতে গিয?ে এলাকাবাসী ও দোকানিদের সঙ্গে আমাদের মজার সব অভিজ্ঞতা হয?েছে। অনেকের কাছ থেকে উৎসাহ আর সহযোগিতাও পেয?েছি।’

এ কর্মসূচি সম্পর্কে ওয?ান ডিগ্রি ইনিশিয?েটিভের প্রতিষ্ঠাতা সাবহানাজ রশীদ বলেন, ‘রাস্তার পাশের সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড কিংবা পোস্টারে প্রায?ই বাংলা ও ইংরেজি শব্দের অদ্ভুত সব বানান দেখা যায?। এটি ভাষার প্রতি অপমান। ভাষার প্রতি সম্মান দেখাতেই আমাদের বছরব্যাপী একটি কর্মসূচি হচ্ছে শুদ্ধ লিখি।’

রণন

রংপুর শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বানান শুদ্ধির কাজ করছে বেগম রোকেয?া বিশ্ববিদ্যালয?ের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘রণন’। সংগঠনটির উদ্যোগে এই শুদ্ধি অভিযান শুরু হয? গত বছরের ফেব্রুয?ারিতে। এরপর বিভিন্ন সময? রণনের ১৫ জন সদস্য রংতুলি হাতে হাজির হয?েছেন শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। কখনো বানান শুদ্ধ করতে, আবার কখনো শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারে সচেতনতার বার্তাটুকু সবার মধ্যে পৌঁছে দিতে। এই উদ্যোগের গোড?ার কথা জানান বেগম রোকেয?া বিশ্ববিদ্যালয?ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও রণনের সভাপতি তুহিন ওয?াদুদ। তিনি বলেন, ‘ভুল বাংলা বানানের সঙ্গে যেন আমাদের প্রতিনিয?ত বসবাস। আমরা যে ভুল করছি, সে বোধটুকুও আমাদের মধ্যে নেই। পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা মেনে নেওয?া যায?, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ বা প্রতিষ্ঠানের নামলিপি লেখার ক্ষেত্রে ভুল বাংলার চল খুবই দৃষ্টিকটু ব্যাপার। আমরা উদ্যোগটি নিয?েছিলাম সবাইকে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারে উদ্যোগী করতে।’

গত সপ্তাহ থেকে তাঁদের এই উদ্যোগ শুরু হয?েছে নতুন মাত্রায?। এবার তাঁরা সচেতনতার জন্য বেছে নিয?েছেন নগরের প্রেস, ডিজিটাল ব্যানার তৈরির দোকান ও সাইনবোর্ড লেখার শিল্পীদের। রণনের সাধারণ সম্পাদক ও ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মনজুর আরিফ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয?ে আমাদের নিয?মিত কাজের বাইরে এই শুদ্ধি অভিযানে বের হতে হয?। শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারে আমরা বিভিন্ন পর্যায?ে প্রশিক্ষণের আয?োজন করব শিগগিরই।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরো খবর
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.