,

তাদের শিক্ষক ছিলেন সাদেক বাচ্চু

সময় ডেস্ক ॥ গত সোমবার চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন দেশের বর্ষীয়ান অভিনেতা সাদেক বাচ্চুকে। তার মৃত্যুতে দেশের শোবিজ অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। হুমায়ুন ফরিদী, রাজিব, নাসির খান মিজু আহমেদের মতো খল অভিনেতারা চলে যাওয়ার পর ঢাকাই চলচ্চিত্র ইন্ডাষ্ট্রি একেবারেই যেনে খল অভিনেতা শূণ্য হয়ে গেছে। সাদেক বাচ্চু তাদের স্মৃতি আকড়ে ধরে পথ চলছিলেন। অবশেষে চলে গেলেন তিনিও। সাদেক বাচ্চু শুধু অভিনেতাই ছিলেন না। একাধারে লেখক, পরিচালকও ছিলেন। আজকে যারা ঢাকাই ছবির তারকা পরিচিতি নিয়ে বীরদর্পে অভিনয় করছেন তাদের অনেকের অভিনয় গুরুও ছিলেন সদ্য প্রয়াত এ অভিনেতা। আর সাদেক বাচ্চুর গুরু ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত মঞ্চ অভিনেতা মোহাম্মদ আনিস। আনিসের কাছে অভিনয় শিখেছিলেন সে সময়ের পর্দা কাঁপানো তারকা আনোয়ার হোসেন, রাজ্জাক ও আনোয়ারারা। আনিস কিভাবে গ্রুমিং করাতেন সেটা আয়ত্তে নিয়েছিলেন সাদেক বাচ্চু।
আর এই সাদেক বাচ্চুর কাছে অভিনয় শিখেছেন নাঈম-শাবনাজ, আমিন খান, শাহীন আলম থেকে শুরু করে হালের বাপ্পী চৌধুরীও।
চলচ্চিত্রে তার প্রথম শিষ্য নাঈম গুরুকে নিয়ে একবার বলেছিলেন, আমি আর শাবনাজ তাকে আংকেল বলে ডাকতাম। শাবনাজের বাবাও মঞ্চে অভিনয় করতেন। বাচ্চু আংকেল ছিলেন তার বন্ধু। মনে পড়ে, প্রথম ছবির শুটিং শুরুর আগে তিনি আমাদের হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন কিভাবে হাঁটতে হয়, কিভাবে ক্যামেরার সামনে লুক দিতে হয়, কোন সংলাপের ডেলিভারি কিভাবে দিতে হয়। আমি বাচ্চু আংকেলের চোখের অভিনয়টা খুব ফলো করতাম। একেকটা সংলাপ বলার সময় তার চোখের ধরনটা থাকত একেক রকম। আর ব্যক্তিমানুষ হিসেবেও বাচ্চু আংকেলের কোনো তুলনা হয় না।
গুরুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ শাবনাজও, আংকেল আমাকে মেয়ের মতো আদর করতেন। অভিনয়ে যেভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন ঠিক সেভাবে আমার আর নাঈমের সম্পর্কের সময়ও সাহায্য করেছেন। আমাদের বিয়ের সাক্ষীও তিনি। পর্দায় হয়তো বেশির ভাগ সময় তাঁকে খল চরিত্রে দেখা যায়। কিন্তু আমার দেখা ভালো মানুষদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি আমাদের পরিবারেরই সদস্য।
বাচ্চুকে তুখোড় অভিনেতা মনে করেন সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা মিশা সওদাগর। তিনি নিজেই বেশ কিছু বিষয় শিখেছেন বাচ্চুর কাছে। সেটা অনায়াসে বাচ্চুর সামনে স্বীকারও করেছেন। মিশা অকপটে অনেক মানুষের মধ্যে বলে দেন বাচ্চু ভাই, এই ডেলিভারিটা কিন্তু আপনার কাছ থেকে নিয়েছি।
আমিন খান বলেন, প্রথম ছবি থেকেই বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। অভিনয়ের নানা বিষয়ে টিপস দিয়েছেন। আমি সেগুলো সাদরে নিয়েছিলাম। আমার কাছে বাচ্চু ভাই একটা ইনস্টিটিউট। এখনকার নতুনরাও যদি বাচ্চু ভাইয়ের কাছে তালিম নিতো, ওরাও উপকৃত হতো।
বাপ্পী চৌধুরীর প্রথম ছবি ‘ভালোবাসার রং’। শুটিং শুরুর আগেই বাপ্পীকে বাচ্চুর হাতে তুলে দেন প্রযোজক আব্দুল আজিজ। বাপ্পী বলেন, অনেকেই হয়তো ভালো অভিনেতা; কিন্তু সবাই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না। তিনি দারুণ একজন শিক্ষক ছিলেন। নতুন অবস্থায় অভিনয়ে বেশ জড়তা ছিল আমার, সেটা কাটিয়ে উঠতে দারুণ সাহায্য করেছিলেন তিনি। দেখা হলেই জিজ্ঞাস করতো আমি কেমন করছি। উনি আমার সিনেমা দেখতেন। কারেকশন পাঠাতেন। সেগুলো আমি শ্রদ্ধাভরে নেয়ার চেষ্টা করতাম।
যে মানুষটা এত তারকার অভিনয়জীবনের প্রথম গুরু, সেই মানুষটা জীবন সায়াহ্নে এসে পান রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি। নায়ক আলমগীর পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে ২০১৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাদেক বাচ্চু।
সাদেক বাচ্চুর আসল নাম মাহবুব আহমেদ সাদেক। চাঁদপুরে দেশের বাড়ি হলেও জন্ম ঢাকায়। সিনেমার কিংবদন্তি মানুষ এহতেশাম চাঁদনী চলচ্চিত্রে তার নাম বদলে সাদেক বাচ্চু করে দেন। সেই থেকেই তিনি এ নামে পরিচিত। টিএন্ডটি নাইট কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেন সাদেক বাচ্চু।
১৯৬৩ সালে খেলাঘরের মাধ্যমে রেডিওতে অভিনয় শুরু করেন সাদেক বাচ্চু। একইসাথে মঞ্চেও বিচরণ করেন। প্রথম থিয়েটার ‘গণনাট্য পরিষদ।’ ১৯৭২-৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যখন এদেশের সাংস্কৃতিক বলয় নতুনভাবে তৈরি হচ্ছিল, তখন যোগ দেন গ্রুপ থিয়েটারের সাথে। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ১৯৭৪ সালে প্রথম টেলিভিশন নাটকে অভিষিক্ত হন।
প্রথম নাটক ছিল প্রথম অঙ্গীকার। নাটকটি পরিচালনা করেন আবুল্লাহ ইউসুফ ইমাম। সোজন বাদিয়ার ঘাট, নকশী কাঁথার মাঠ সহ অসংখ্য নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন। ঝুলিতে যুক্ত হয় প্রচুর সুপারহিট নাটক।
প্রথম চলচ্চিত্র শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রামের সুমতি’ অবলম্বনে একই নামের ছবি, নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন। শহীদুল আমিন ছিলেন পরিচালক। আরো একটি চলচ্চিত্রেও সুনেত্রার বিপরীতে নায়ক চরিত্রে ছিলেন কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায়নি। খল চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন ‘সুখের সন্ধানে’ চলচ্চিত্রে। শহীদুল হক খানের এই ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চন নায়ক ছিলেন।
মৌসুমী চলচ্চিত্রে ‘চাচা ঢাকা কতদূর?’ সাদেক বাচ্চুর এই সংলাপটি ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে। এরপর বহু সিনেমায় তাকে দেখা গেছে দুর্দান্ত অভিনয়ে।
সাদেক বাচ্চুর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- জোর করে ভালোবাসা হয় না (২০১৩), জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার (২০১৩), জীবন নদীর তীরে (২০১৩), তোমার মাঝে আমি (২০১৩), ঢাকা টু বোম্বে (২০১৩), ভালোবাসা জিন্দাবাদ (২০১৩), এক জবান (২০১০), আমার স্বপ্ন আমার সংসার (২০১০), মন বসে না পড়ার টেবিলে (২০০৯), বধূবরণ (২০০৮), ময়দান (২০০৭), আমার প্রাণের স্বামী (২০০৭), আনন্দ অশ্রু (১৯৯৭), প্রিয়জন (১৯৯৬), সুজন সখি (১৯৯৪)।


     এই বিভাগের আরো খবর