,

করোনাকালে ওষুধ রপ্তানিতে সাফল্য

সময় ডেস্ক ॥ করোনা মহামারির প্রভাবে বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিল্পের আয় ব্যাপক পরিমাণে কমেছে। হুমকির মুখে হাজারো প্রতিষ্ঠান। তবে এর ঠিক বিপরীত চিত্র ওষুধ শিল্প খাতে। সম্পূর্ণ এবং অফিসিয়াল তথ্য প্রকাশ করা না হলেও এই খাতের শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, করোনাকালে দেশের ওষুধের বাজারে দুর্দান্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যেও এর সত্যতা মিলেছে। এ ছাড়া এ শিল্পের অভাবনীয় উন্নতি হওয়ায় বাংলাদেশি ওষুধ শিল্পের সুনাম এখন বিশ্বজুড়ে। ফলে দিন দিন বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশি ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। এর মূল কারণ হলো দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎকৃষ্টমানের ওষুধ উৎপাদন। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওষুধ রপ্তানি করে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড (বিপিএল) আগেই নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। প্রতিবছর দেশীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে ওষুধ রপ্তানি হয় বিশ্বের প্রায় ১৬০ দেশে। সবমিলিয়ে এ খাতের বাৎসরিক বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকায়। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মুহূর্তে ওষুধ শিল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ কাঁচামাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। তাহলে আরও এগিয়ে যাবে এ খাত। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ইপিবি, বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি (বিএএসএস) ও বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির (বিএপিআই) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, করোনা মহামারিতে অন্য সব খাত যখন ভুগছে, ঠিক তখনই চাঙ্গাভাব ধরে রেখেছে ওষুধ শিল্প। কাঁচামাল আমদানিতে কিছুটা প্রভাব পড়লেও বেড়েছে ওষুধের চাহিদা। বিশেষ করে করোনা সংক্রান্ত ওষুধের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি দেশীয় কোম্পানি উন্নত দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস বা জিএমপি সনদ লাভ করেছে। বেক্সিমকোসহ বেশকিছু শীর্ষ ওষুধ কোম্পানি এরইমধ্যে বৈশ্বিক ওষুধ খাতের বড় সনদ অর্জন করেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ, যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, ইউরোপের ইইউ, অস্ট্রেলিয়ার টিজিএ ইত্যাদি। বাংলাদেশে জেনেরিক ওষুধের বিরাট বাজার রয়েছে এবং দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেক্সিমকো বহির্বিশ্বে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা বলেন, মহামারি সত্ত্বেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং দেশ-বিদেশের বাজারে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করে যাচ্ছে। এই শিল্পের প্রবৃদ্ধি অর্জন বাড়ছে। উদ্যোক্তারা জানান, করোনাকালে ওষুধ প্রস্তুতকারীরা তুলনামূলকভাবে অন্যদের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো জেনেরিক অ্যান্টি-করোনাভাইরাস ওষুধ তৈরি করেছে, যা বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করেছে। ওষুধ শিল্প মহামারির এই সময়ে তার সক্ষমতা দেখিয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে এই মহামারি আরও ভালোভাবে মোকাবিলায় সহায়তা করেছেন। তারা বলেন, মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে এই শিল্পটি কাঁচামাল আমদানিতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু ওষুধ সব দেশের জন্যই প্রয়োজনীয় পণ্য। তাই করোনার প্রাদুর্ভাবের পরও রপ্তানি ও দেশীয় বিক্রি কমেনি। আমরা ব্যক্তিগতভাবে ক্লায়েন্টদের কাছে যেতে না পারলেও ক্রেতারা অনলাইনে যোগাযোগ করে নতুন অর্ডার দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক এসএম শফিউজ্জামান বলেন, অ্যান্টি-করোনাভাইরাস ড্রাগ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরির প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। ফেভিপিরাভির ও রেমডেসিভিরের মতো ওষুধ উৎপাদন এই শিল্পের জন্য একটি দুর্দান্ত অর্জন ছিল। সারা পৃথিবীর মানুষ এই ওষুধ উপযুক্ত দামে কেনার সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশি রেমডেসিভির মধ্য আমেরিকা, মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকায় রপ্তানি করা হয়েছে। তিনি বলেন, মুন্সীগঞ্জের এপিআই পার্ক পুরোপরি চালু হলে ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের জন্য আর কারও মুখাপেক্ষী হতে হবে না। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্য মতে, দেশ স্বাধীনের পর মোট চাহিদার মাত্র ২০ ভাগ বাংলাদেশ উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল, আর ৮০ ভাগই নির্ভর করতো বৈদেশিক আমদানির ওপর। বর্তমানে ওষুধের মোট চাহিদার শতকরা ৯৭ ভাগ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ওষুধ দ্বারা মেটানো হচ্ছে। এ ছাড়া আগামী ২০২১ সালের মধ্যে ওষুধ রপ্তানি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার এবং আগামী ১০ বছরে ১৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করছে সরকার। ওষুধ উৎপাদনের জন্য বর্তমানে দেশে কাজ করে যাচ্ছে দুই শতাধিক ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি। এসব কোম্পানিতে প্রতি বছর ২৪ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, জাতীয় অর্থনীতিতে ওষুধ শিল্পের অবদান বাড়ছে। জিডিপিতে ওষুধ খাতের অবদান প্রায় ২ শতাংশ। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের গত ১১ মাসে ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৪ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। এই ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮.৯৯ শতাংশ। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের এই সময় রপ্তানি হয়েছিল ১২ কোটি ২২ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করেছে ১৩ কোটি ডলার, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ১০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি হয়েছে ১৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। আগের বছরের চেয়ে ওষুধ রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪.৪৯ শতাংশ। ইপিবির তথ্য মতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করে ৩৮৬ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৮ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৫৪ কোটি টাকা। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ কিছুটা কমে হয় ৫৪১ কোটি টাকা। এরপর আবার রপ্তানি আয়ের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয় হয় ৬৫৭ কোটি টাকা ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করে আয় করে ৭১৪ কোটি টাকা। ওষুধ রপ্তানিকারকরা মনে করছেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা বা এলডিসি হিসেবে ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্ব ছাড় ১৭ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প খাতে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব ছাড় পাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওষুধ রপ্তানির আকার বাড়াতে চান উদ্যোক্তারা। তারা জানান, রপ্তানি আরও বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। ইতিমধ্যে দেশের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওষুধ রপ্তানির অনুমোদন পেয়েছে। ফলে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি ওষুধ রপ্তানির দরজা খুলছে। এখন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব কারখানায় ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে উৎপাদনও অনেকগুণ বেড়েছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং দক্ষ ফার্মাসিস্টদের সহায়তায় বর্তমানে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের ওষুধও দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। এদিকে নজরদারির অভাবে নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে বাজারজাত করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান যাতে দেশের সুনাম নষ্ট করতে না পারে সেদিকে নজর রাখার তাগিদ বিশ্লেষকদের। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সভাপতি সাদেকুর রহমান বলেন, ওষুধের চাহিদা ভালোই। কিন্তু অনেক কোম্পানি কাঁচামাল সংকটের কারণে পর্যাপ্ত ওষুধ উৎপাদন করতে পারছে না।


     এই বিভাগের আরো খবর