,

চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা একটি ভূরাজনৈতিক পর্যালোচনা ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তি মূলক প্রচারনা প্রসঙ্গ

মতিয়ার চৌধুরী : এ বছরের ফেব্রুয়ারীতে চীনে প্রথম করোনা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং ক্রমান্বয়ে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এপর্যন্ত সাড়া দুনিয়ায় এই রোগে মারা গেছেন প্রায় চার লক্ষ মানুষ আক্রন্ত হয়েছেন তিন কোটিরও বেশী। কোন দেশই মরণব্যাধি এই ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেনা। বিশ্বের প্রতিটি দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর প্রতিশেধক আবিস্কারে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিশ্চিত করে বলা মুশ্ধিসঢ়;কল কবে এর থেকে পৃথিবীবাসী রেহাই পাবে। আর করোনা পরিস্থিতির কারণে সমগ্র বিশ্বে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। এশিয়ায় এর সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা। এই সীমান্ত উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববাসী শংকিত,তবে শান্তিকামী মানুষ কোন সময়ই যুদ্ধ পছন্দ করেনা, চায় শান্তি। যদি চীন
ভারত যুদ্ধ শুরু হয় তা করোনার মতো ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী। এটি চীন এবং ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেনা। এখান থেকেই শুরু হয়ে যেতে পারে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ এমনইি আশংকা করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তবে বিশ্বযুদ্ধ হউক বা না হউক, যদি উভয় দেশের মধ্যে সংঘাত বাড়তে থাকে এর প্রভাব পড়বে সার্কভূক্ত দেশসমূহ সহ সমগ্র সাউথ এশিয়ায়। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশ-ভূটান নেপাল
মিয়ানমার সহ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশ। এতে লাভবান হবে পাকিস্থান সবচাইতে বেশী। পাকিস্থান চাইছে উভয় দেশের মাঝে একটি যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজ করুন। পাকিস্তান তাদের চিরশত্রু ভারতের উপর প্রতিশোধ নিতে পারবে। আর একারনেই পাকিস্থান কাশ্মিরে যেমন জঙ্গিগোষ্টিকে প্রকাশ্যে মদদ দিচ্ছে অন্য দিকে বিপুল পরিমান অর্থ খরছ করছে চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনাকে ইস্যু করে উপমহাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে একটি ভারত বিদ্ধেষী মনোভাব তৈরীতে । এছাড়া ভারতের কয়েকটি
বিচ্ছিহ্নতাবাদী গ্রুপের পেছনে প্রচুর অর্থ খরছ করছে পাকিস্থান। বিশেষ করে ইউরোপ আমেরিকায় বসবাসরত কাশ্মিমিরী বিচ্ছিহ্নতাবাদী, খালিস্থান, মনিপুরি বিদ্রোহী এবং বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সদস্যদের ব্যবহার করছে পাকিস্থান। বাংলাদেশের কয়েকটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সংগঠনের নেতাদের প্রায়ই দেখা যায় লন্ডনে সভা সেমিনার করে ভারত-বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালাতে। পাকিস্থানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর অর্থায়নে লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশের চিহ্নিত কয়েকটি উগ্রপন্থি সংগঠনের সদস্যদের দিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে চীন-ভারত সীমান্ত ইস্যুকে সামনে রেখে বিভ্রান্তি মুলক প্রচারণা। আসলে বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন। ভারতের ৯৮% মানুষ কখনোই চায়না ভারত খন্ড খন্ড হয়ে ভাগ হয়ে যাক। যারা ভারত থেকে বিচ্ছিহ্ন হতে চায় তাদের সংখ্যা মাত্র ২% আর এরা সকলেই বিশ্বের অন্যান্য দেশে বসবাসরত অর্থাৎ প্রবাসী , তাদের দিন কাটছে বেশ আরাম আয়েশেই। কাশ্মিরের যেসব নাগরিক লন্ডনে জম্মু-কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার তাদের ৯৫% পাকিস্থান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মিরের নাগরিক। যেসব উগ্রবাদি ব্রিটিশ বাংলাদেশীকে পাকিস্থান এই অপপ্রচারে নিয়োগ দিয়েছে তাদের সকলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী জামাত নিয়ন্ত্রিত ও তাদের রাজনৈতিক সহযোগী।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেইসবুক-টুইটার, বা ইউটিউব এর মতো যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় চীন ভারত সীমান্ত উত্তেজনাকে ইস্যু করে বিভ্রান্তি মূলক প্রচারনা। আর যারা ফেইক আইডি ব্যবহার করে এসব অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই বিট্রিশ পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী। উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং সাম্প্রদায়িক। বাংলাদেশের এই সাম্প্রদায়িক গোষ্টী চাইছে যদি কোন ভাবে বাংলাদেরেশর অভ্যন্তরে বা ভারতে যদি একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরী করা যায় তাহলে তারা লাভবান হবে। এই গোষ্টীর লক্ষ্য একটাই বাংলাদেশে চলমান মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ হউক, অন্যদিকে থেমে যাক দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি। গেল কয়েক বছরে বাংলাদেশে তারা চেষ্টা করেছে কিন্তু সফল হতে পারেনি।
বিশেষ করে ব্রাম্মন বাড়িয়ার নাসির নগর, যশোর, এবং চট্রগ্রামর কথাই ধরা যাক। তবে কিছু সংখ্যক ধর্মান্ধ এবং চিহ্নিত কয়েকটি উগ্রবাদী সংগঠন ব্যতিত বাংলাদেশের মানুষ সব সময়ই সাম্প্রদায়িক সম্পৃতিতে বিশ্বাসী। এরা বার বার চেষ্টা করেছে ব্যর্থ হয়েছে এখন আবার নতুন করে পাকিস্থানের পৃষ্টপোষকতায় তাদের পূরানো ডাটা বাস্তবায়ন করতে মাঠে নেমেছে। তবে সব চেয়ে স্বস্থির খবর হলো উভয় দেশের কুটনৈতিক আলোচনায় ভারত এবং চীন একটি সমোজতায় পৌঁচেছে। দেখা যাচ্ছে চীন সীমান্ত রেখা থেকে তাদের সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে। এখন আসা যাক একটি ভূরাজনৈতিক
পর্য্যালোচনায়। আন্তর্জাতিক কয়েকটি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, চীন-ভারত কেউই-কারো চাইতে দুর্বল নয়। উভয় দেশই সামরিক শক্তিতে সমান পারদর্শি। নিরপেক্ষ ভাবে
ভূরাজনৈতিক পর্যবেক্ষনে দেখা গেছে চীনের সাথে যুদ্ধে ভারত কোন অংশেই কম নয়। চীন বিশ্বের একটি অন্যতম সুপার পাওয়ার, তারা বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ আমেরিকাকে সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক ভাবে টেক্কা দেওয়ার সামর্থ রাখে। সৈন্য
লোকবল ও আধুনিক সমরাস্ত্রে ভারত ও পিচিয়ে নেই। চীনকে মোকাবেলা করার মতো তাদের যথেষ্ট সামর্থ রয়েছে। সাউথ এশিয়ার প্রায় সবকটি দেশই ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র। একমাত্র পাকিস্থান ভারতের চিরশত্রু। ভূটান নেপালের মতো দেশ গুলো ভারত নির্ভর। যুদ্ধ বাধলেও সাউথ এশিয়ার কোন দেশ পাকিস্থান ব্যতিত আর কেউ চীনের পক্ষ নেবেনা। বাংলাদেশের কয়েকটি চিহ্নিত উগ্রবাদী দলের কিছূ সংখ্যক সদস্য ছাড়া বাংলাদেশের নাগরিকদের কেউই ভারত বিরোধী নয়। অন্যদিকে চীনকে বাংলাদেশের মানুষ বন্ধু হিসেবে দেখে। কেননা বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মেঘা প্রজেক্ট চীনের
সহযোগীতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে, এই মূহুর্থে বাংলাদেশ কখনোই চাইবেনা চীন-ভারত যুদ্ধ বাধুক। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান সব চাইতে বেশী। ভারতের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এত সহজ হতো না। এছাড়া বাংলাদেশের সব চাইতে ঘনিষ্ট বন্ধু এবং নিকট প্রতিবেশী হচ্ছে ভারত। বাংলাদেশের যে কোন দলই ক্ষমতায় থাকুক কারো পক্ষেই ভারতের বিরোধীতা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পলিসি হচ্ছে কারো সাথে শত্রুতা নয় বন্ধুত্ব। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ বিচক্ষন। তার রাজনৈতক প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষনতার কারনে শত প্রতিকুলতার মাঝেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এছাড়া তার পররাষ্ট্রনীতি বিশ্ববাসীর কাছে বেশ প্রশংসিত। বিশেষ করে সাউথ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে প্রতিবেশী দেশ গুলোর সাথে সম্পর্ক আরো জোরালো হয়েছে। চীন অবশ্যই ভাল করে জানে ভারতের সাথে তাদের যুদ্ধ বাধলে বিশ্বের অন্য দুই পরাশক্তি আমেরিকা এবং রাশিয়া ভারতের পাশে থাকবে। কেননা এখানে হিসেব একটু ভিন্ন, আমেরিকা চাইছে সাউথ এশিয়ায় তাদের অবস্থান শক্ত করতে অন্যদিকে চীন দিনে দিনে হয়ে উঠছে সব দিক থেকে শক্তিশালী। বর্তমান সময়ে চীনের অর্থনৈতিক পাওয়ার আমেরিকার চাইতে কম নয়, সুতরাং সঙ্গত কারনেই আমেরিকা রাশিয়া বা জাপানের মতো দেশ কোনদিনই চিনের পক্ষ নেবেনা। পাকিস্তান এতোদিন আমেরিকার ভাল বন্ধু হিসেবে থাকলেও বর্তমান সময়ে জঙ্গিদের রাষ্ট্রীয় ভাবে মদদ দেবার কারনে পাকিস্তানকে ভাল চোখে দেখছেনা আমেরিকা। এছাড়া চীনও জঙ্গিদের প্রশ্রয় দিতে রাজি নয়, সুতরাং যুদ্ধে জড়ানোর আগে চীনকে অনেক বিষয়ে ভাবতে হবে। বর্তমান সময়ে চীনের যে পলিসি তা আমেরিকার মতো নয় তারা চাইছে সমগ্র বিশ্বে তাদের পন্যের বাজার সৃষ্টি করতে। এমনকি ভারতেও তাদের ইনভেষ্ট ররয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেবার ক্ষমতাসম্পন্নন দেশগুলো কোন দিনই চাইবেনা সমক্ষমতা সম্পন্ন অন্য দেশের সরাসরি বিরোধীতা করতে। আর এসব বিচার বিশ্লেষনে প্রতিয়মান হয় যুদ্ধ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। বাংলাদেশের অবস্থান বেশ পরিস্কার সাংবিধানিক স্পিরিট বজায় রেখে কোন পক্ষের দিকে সরাসরি অবস্থান না নিয়ে শান্তির পক্ষে কাজ করছে বাংলাদেশ। তার কারণ হলো বাংলাদেশের পক্ষে কোনদিনই ভারতকে পরিহার করা সম্ভব নয় অন্যদিকে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ চীন। সুতরাং বাংলাদেশ মনে প্রাণে চায় শান্তি। চীনও চাইছেনা যুদ্ধে জড়াতে তবে আমেরিকাকে নিয়ে চীনের ভয় আছে তাই চীন কোনদিনই চাইবেনা প্রতিবেশীর সাথে তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। আমরা যুদ্ধ চাই না শান্তি চাই, যুদ্ধ করো জন্যে মঙ্গল বয়ে আনেনা। চীন ভারতের বিরোধপুর্ন বিষয়গুলো কুটনৈতিক ভাবে শান্তিপূর্ন ভাবে সমাধান হউক। আর সে পথেই এগুচ্ছে উভয় দেশ।

লেখক

মতিয়ার চৌধুরী

যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক কলামিষ্ট


     এই বিভাগের আরো খবর