,

সরকারি চাকরির ভূয়া নিয়োগপত্র ও সীলসহ মাধবপুরের প্রতারক গ্রেফতার, ভূয়া এসপি রাহুলের প্রতারণাকেও হার মানিয়েছে খোকনের প্রতারণা

মন্ত্রী-এমপি ও সচিবের পিএস পরিচয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ,

প্রতারণা থেকে বাদ যায়নি পুলিশ-সাংবাদিকও,

একাধিক বিয়েও করেছে এই প্রতারক

জুয়েল চৌধুরী :  হবিগঞ্জের মাধবপুরে নারী লোভী এক প্রতারককে গ্রেফতার করেছে ডিবি ও এনএসআই। এ যেনো বিশ্ব বাটপার প্রতারক সাহেদেরই আরেক সহযোগী। তবে প্রতারণায় সাহেদকে হার মানাতে না পারলেও হার মানিয়েছে কিছুদিন আগে ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া হবিগঞ্জ শহরের ভূয়া এসপি রাহুলকে। আলোচিত রিজেন্ট সাহেদ মহামারী করোনার সনদ নিয়ে জালিয়াতি করে আলোচনায় এলেও মাধবপুরে গ্রেফতার হওয়া এই প্রতারক সরকারি চাকরির নিয়োগ জালিয়াতিতে শীর্ষে রয়েছে। কয়েক বছর ধরে জালিয়াতি করলেও আগে আলোচনায় তেমন আসেনি। আর এলেও স্থানীয় নেতা পাতিনেতাদের ম্যানেজ করে আড়াল করে রেখেছিল তার প্রতারণার কাহিনী। বলছিলাম দেশের বিভিন্ন জেলার সরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের সাথে নিয়োগ নিয়ে প্রতারণায় অভিযুক্ত মাধবপুর উপজেলার বাসিন্দা এক সময়ের পুরাতন কাপড় বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন ওরফে খোকন নামের এক প্রতারকের কোটপতি হবার কথা। এতোদিন সে কৌশলে প্রতারণা করলেও হবিগঞ্জ জেলা এনএসআই ও ডিবি পুলিশ যৌথ অভিযানে অবশেষে তাকে গ্রেফতার করেছে। গত, ১৬ জুলাই (বৃহস্পতিবার) মধ্যরাতে অভিযানকালে তার কাছ থেকে নগদ টাকা সরকারি নিয়োগের ভূয়া কপিসহ ভুয়া সিল ও নিয়োগপত্র উদ্ধার করা হয়।

এনএসআই ও ডিবি সূত্রে জানা যায়, মাধবপুর উপজেলার বানেশ্বরপুর গ্রামের বাসিন্দা এক সময়ের পুরাতন কাপড় বিক্রেতা আবুল হোসেনের ছেলে দেলোয়ার হোসেন খোকন (৪২) দীর্ঘদিন ধরে টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন কার্যালয়ের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ভূয়া সাক্ষর সীল তৈরি করে চাকুরির নিয়োগপত্রের ব্যবসা করে আসছে। গোপন সুত্রের সংবাদের ভিত্তিতে হবিগঞ্জ এনএসআই অনুসন্ধান করে ঘটনার সত্যতা পায়। পরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জেলা এনএসআই হবিগঞ্জ এর নেতৃত্বে ডিবি পুলিশের একটি টিম গত, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১০ টায় বানেশ্বরপুর গ্রামে অভিযান চালায়। এসময় প্রতারক চক্রের হোতা দেলোয়ার হোসেন খোকন (৪২) কে তার নিজ বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ নকল সীল, ভূয়া নিয়োগপত্র ও নগদ ৫ হাজার টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। এনএসআই ও ডিবির যৌথ জিজ্ঞাসাবাদে অন্তত ২০ লোকের কাছ থেকে চাকুরী দেওয়ার নামে প্রায় লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে গ্রেফতার দেলোয়ার হোসেন খোকন স্বীকারোক্তি দেয়। অভিযানে নেতৃত্ব দেন হবিগঞ্জ জেলা এনএসআই এর ডিডি মোঃ আজমল হোসেন ও এডি মোঃ হুমায়ুন। এব্যাপারে ডিবি পুলিশ বাদি খোকনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।

এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগী সূত্র জানায়, সে শুধু সরকারি চাকরির নামে প্রতারণা করেই ক্ষান্ত হয়নি। তার গ্রেফতারের খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে তার ভন্ডামীর রহস্য ফাঁস করেন গ্রামবাসী। প্রতারক খোকনের অপরাধের কাহিনী ও কৌশল বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এক ভুক্তভোগী জানান, সে রিজেন্ট সাহেদের সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে প্রতারণা করতো। রিজেন্ট সাহেদ বড় বড় নেতা, মন্ত্রী এমপিদের সাথে ছবি তোলে প্রতারণা করলেও দেলোয়ার হোসেন খোকন কারো সাথে ছবি তোলতো না। সে প্রত্যেক শহরের একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে টার্গেট করতো। যার কথা ভুক্তভোগী শুনে এমন লোককে তার ফাঁদে ফেলে। এছাড়াও ইদানীং রিজেন্ট সাহেদের মত করোনা পরীক্ষা নিয়েও জালিয়াতির পরিকল্পনা করছিল বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। শুধু নিয়োগ নিয়েই প্রতারণা নয়, করেছে বিয়ে নিয়েও প্রতারণা। একে একে ৪টি বিয়ে করেছে। সরকারি চাকরি দেয়ার কথা বলে যেখানে যেতো সেখানে সুন্দরী মেয়েদের টার্গেট করতো। এ ছাড়াও নিজেকে এমপি, মন্ত্রির ও সচিবের ঘনিষ্টজন কখনও কখনও নিজেকে নৌবাহিনীতে চাকুরীজীবি হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে সে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এ ছাড়া চাকুরী দেওয়া এবং বিয়ের প্রলোভনে স্কুল পড়ুয়া মেয়ের সম্ভ্রমহানির খোঁজও পাওয়া গেছে। বহুরুপী প্রতারক দেলোয়ার হোসেন খোকনের নামে হবিগঞ্জ নারী শিশু আদালতে অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা এক মামলার তদন্ত করতে গিয়ে খোকনের অন্তরালের খবর বের করে আনেন, মাধবপুর থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) সাজেদুল ইসলাম পলাশ। তদন্তে বেরিয়ে আসে মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘর ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামের মোহন মিয়া বাদী হয়ে তার স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে অপহরণ ও ধর্ষনের অভিযোগ এনে মামলা দায়েরের কথা। ওই মামলাটি বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে মাধবপুর থানায় মামলাটি এফআইআর গন্য রুজ্জু হয়। যার নং ১১/১৬। মামলার এজাহারে অপহরন ও ধর্ষণ শেষে ফেলে রেখে যাওয়ার অভিযোগ করা হলেও প্রেমের সর্ম্পকের সত্যতা পাওয়া যায়।
তদন্ত সুত্রে জানা যায়, কখনও নিজের নাম ঠিকানা গোপন রেখে ছদ্মনামে নিজেকে চাকুরীজীবি পরিচয়ে মোবাইল ফোনের দীর্ঘদিনের প্রেমের স্বীকৃতি দিয়ে প্রেমিকার ডাকে সাড়া দিয়ে হাতধরে পালিয়ে যায় স্কুল পড়ুয়া মোহন মিয়ার মেয়ে। এরই বিহীত করতে তদন্তের স্বার্থে এজাহারে উল্লেখ করা মোবাইলের কললিষ্ট ও বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা হলে বেরিয়ে আসে খোকন বিগত ৭-৮ বছর আগে কুয়েতে গিয়ে
অবস্থানকালে সেখান থেকে মোবাইল ফোনে বগুড়ার মমতাজ বেগম নামে এক কিশোরীকে বিয়ে করে। দেশে এসে খুলনা থেকে তাকে নিয়ে এসে প্রায় ২ বছরের সংসার জীবনে খোকনের দুশ্চরিত্র তার কাছে প্রকাশ পেতে থাকে। সংসারের টানা পোড়ন থাকায় স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মমতাজ বগুড়া বাবার বাড়ী চলে গেলে ভবানীপুর গ্রামের ফুলমিয়ার মেয়ে সেলিনা আক্তারকে বিয়ে করে। সেলিনার কুল জুড়ে আসে দুটি সন্তান। স্ত্রী সন্তানদের ফেলে ধর্মঘর একই ইউনিয়নের বীরসিংহ পাড়ার তিতু মিয়ার অনার্স পড়ুয়া কন্যা সোনিয়া আক্তারের সাথে মোবাইলে প্রেমের সর্ম্পক তৈরী করে ২০১৬ সালের ১৯ জুন জাল জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে হবিগঞ্জ নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ে করে ৫লক্ষ টাকা দেন মোহরে। ৪র্থ পর্যায়ে মোহনপুরের মোহন মিয়ার মেয়ের সাথে মোবাইলে নিজেকে নৌ বাহিনীর অফিসার পদে চাকুরীজীবি পরিচয় দিয়ে প্রেমের সর্ম্পক গড়ে তোলে। বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ওই মেয়েকে নিয়ে বিভিন্ন হোটেলে রাত্রি যাপন করে পরপর ৭দিন কাটিয়ে ঢাকা এয়ারপোর্ট রেল ষ্টেশনে রেখে পালিয়ে যায় খোকন। এ ঘটনায় মোহন বাদী হয়ে সর্ম্পক স্থাপনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার দিয়ে একজন জনপ্রতিনিধির প্ররোচনায় আন্দিউড়া গ্রামের একটি  পরিবারের সরকারী চাকুরীজীবি ও তার পিতা ভাইকে অপহরন ও ধর্ষন মামলা করে। আর এই মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে মাধবপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাজেদুল ইসলাম পলাশ দীর্ঘ দিন তদন্ত করে প্রতারক খোকনের বিয়ে বিয়ে খেলার রহস্য উন্মোচন করেন। নারীর প্রতি লোভ দেখিয়েই সে ক্রান্ত থাকেনি পাশাপাশি খোকন
নিজেকে কখনও এমপি, মন্ত্রির ও সচিবের ঘনিষ্টজন পরিচয় দিয়ে চাকুরীর লোভ দেখিয়ে এলাকার নিরীহ সরল মনা যুবকদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়। তার প্রতারণার শিকার থেকে বাদ যায়নি পুলিশ আর সাংবাদিকও। তার প্রতারণার শিকার হবিগঞ্জ শহরের শায়েস্তানগর এলাকার বাসিন্দা এক সাংবাদিকও। তার প্রায় ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় ওই প্রতারক। জানা যায়, খোকন নিজেকে তথ্যমন্ত্রণালয়ের সাবেক এক সচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের ঘনিষ্ঠজন দাবি করে টাকা হাতিয়ে নিত। হবিগঞ্জ শহরে রয়েছে তার একাধিক গডফাদার। মাধবপুরেও। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মাধবপুর উপজেলার চৌমুহনী ইউনিয়নের বানেশ্বরপুর গ্রামের আবুল হোসেন চৌমুহনী বাজারে ফুটপাতে বসে কাপড় বিক্রয় করতেন। তাকে সহযোগিতা করতো তার ছেলে খোকন । ৭-৮ বছর পূর্বে খোকন কাজের জন্য কুয়েত চলে যায়। সেখানেও খোকন বিভিন্ন অপরাধ করলে স্থানীয় বাংলাদেশীরা তাকে দেশে পাঠিয়ে। কুয়েত ফেরত খোকন ঢাকায় প্রাইভেট কোম্পানীতে কিছু দিন চাকুরী করার পর এলাকায় এসে প্রচার করে অমুক সচিব তমুক সচিব তার ঘনিষ্টজন। এই সচিবদের মাধ্যমে চাকুরী দেওয়ার নাম করে এলাকার যুবকদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়। কিন্তু তার প্রতারণা এলাকাব্যাপী থাকেনি। সে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তৃত করে তার প্রতারণার জাল। গাইবান্ধা, কুষ্টিয়া, রংপুর, নীলফামারীর সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসে কয়েকজন সচিবের নাম ভাঙিয়ে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চাকুরী দেওয়ার লোভ দেখিয়ে খোকন কুষ্টিয়ার এক পুলিশ অফিসারের আত্মীয়ের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। এ বিষয়ে ঢাকা সিএম আদালতে দায়েরকৃত মামলায় তার বিরোদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা রয়েছে। নারী লোভী খোকনের চাকুরীর প্রলোভনে প্রতারণার স্বীকার হয়ে স্থানীয় যুবক শমসের আলী, তাজুল ইসলাম লিটু, হাবিুবুর রহমান লিমন, তাপসসহ আরও কয়েকজন জানান, আমরা সরল বিশ্বাসে চাকুরী পাওয়ার লোভে তাকে টাকা দিয়ে আমরা দিশেহারা। সে একাধিক নম্বর ব্যবহার করায় তাকে পাওয়া যায় না। আমরা বার বার তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেও কোন সমাধান পাচ্ছি না।

নাম প্রকাশে অনিইচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সাধারণ কাপড় বিক্রেতা থেকে খোকন যখন হঠাৎ করে সে কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। এখন সে কোটিপতি। আনুমানিক ৩-৪ কোটি টাকার মালিক সে।

এ বিষয়ে মাধবপুর থানার ওসি ইকবাল হোসেন জানান, তার বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদন করা হচ্ছে। রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার গডফাদারের নামসহ আরো প্রতারণার কাহিনী বেরিয়ে আসবে।


     এই বিভাগের আরো খবর