,

একজন ফজলুল হক চৌধুরী সকলের সেলিম ভাই

“নবীগঞ্জের মাটিরে, সোনার চেয়ে খাঁটিরে/গানে ভরা প্রাণে ভরা, সবুজ শীতল পাটিরে…।” জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী নকুল বিশ্বাস অনেক বছর আগে নবীগঞ্জ জে, কে হাইস্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত একটি কনসার্টে গানটি গেয়ে ছিলেন। আজও গানটি আমার মনে দোলা দেয়। নবীগঞ্জ বৃহত্তর সিলেটের একটি ঐতিহ্যবাহী পুরাতন জনপদ। সোনার চেয়ে খাঁটি এই মাটিতে জন্ম হয়েছে অনেক ণজন্মা গুণীজনের। যাঁরা স্বমহিমায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রেখেছেন অবদান। উজ্জ্বল করেছেন জন্মভূমি নবীগঞ্জের নাম। তাঁদের কেউ শিক্ষক, চিকিৎসক, ব্যবসায়িক, সরকারি কর্মকর্তা, কবি-সাহিত্যিক, গবেষক, দেশপ্রেমিক যোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি কিংবা রাজনৈতিক নেতা। তেমনি একজন রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম। নবীগঞ্জ উপজেলার চলমান সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক আলোচিত ও অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব সেলিম ভাই। পোষাকি নাম মোঃ ফজলুল হক চৌধুরী। কিন্তু নবীগঞ্জবাসী, পরিচিতজন, কিছু প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি ‘সেলিম ভাই’ এই নামেই তিনি বিখ্যাত ও সুপরিচিত। তিনি পূর্ব বাংলার সিলেট জেলাধীন নবীগঞ্জ থানার মান্দারকান্দি পরগণার চরগাঁও গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল হক চৌধুরী ও মাতা সুফিয়া হক চৌধুরী। দুই ভাই ও ৭ বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। পড়াশোনা করেন সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও নবীগঞ্জ জে,কে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। তাঁর পিতা আব্দুল হক চৌধুরী স্বাধীনতাত্তোর কালে নবীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চার বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও নবীগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক। বড় চাচা আব্দুল আজিজ চৌধুরী ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ ও ১৯৭০’র নবীগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ)। পিতামহ আরজদ চৌধুরী ছিলেন নবীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন কাউন্সিলের (তখন ইউনিয়ন পরিষদের নাম ছিল ইউনিয়ন কাউন্সিল) সদস্য (বিডি মেম্বার-১৯৬০) ও মাওলানা ভাসানীর আদর্শের অনুসারী। ছাত্রাবস্থায়ই তাঁর নেতৃত্ববগুণ ও বহুমাত্রিক প্রতিভা ফুটে ওঠে এবং পূর্বজদের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা অনেকটাই সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট হন।

সেলিম ভাই পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ছাত্র জীবনেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় নবীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হন এবং একটা সময় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের যুব সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ নবীগঞ্জ উপজেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বর্তমানে আহবায়কের দায়িত্বে নিযুক্ত আছেন। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে নবীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করনের লক্ষ্যে সরকার পুনরায় উপজেলা পরিষদ চালু করলে এবং ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং প্রথম বারের মতো ভাইস-চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করলে, তিনি নবীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন এবং সিলেট বিভাগের ভাইস-চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থেকে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম সরওয়ার হাদী গাজী মৃত্যু বরন করলে তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাস পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন।
সেলিম ভাইয়ের দিন শুরু হয় লোকজনের আর্জি শুনে। তাঁর রান্না ঘর পর্যন্ত সকল পর্যায়ের মানুষদের জন্য উন্মুক্ত। ঘুম থেকে উঠে ঘুমানোর পূর্ব পর্যন্ত এলাকার সমস্যাবলী সমাধানে তৎপর। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত, উদার মানবিক চেতনায় বিশ্বাসী এই কর্মঠ নেতা কাউকে মিথ্যা আশ্বাস দেন না। সরকার স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করনের লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদ চালু করলেও চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানদের জন্য যা বরাদ্দ প্রদান করা হয় তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। যার ফলে বিশাল জনগোষ্ঠীর ভোটে নির্বাচিত হলেও বরাদ্দ বিশাল না পাওয়াতে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভোটারদের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় তাঁকে প্রায়ই বিমর্ষ দেখা যায়। কিন্তু তাঁর কাছে কেউ উন্নয়ন কাজে বরাদ্দের জন্য আসলে, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন দিতে না পরলে কথা দিয়ে হলেও অনেকটা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিজ বাড়ির পাশাপাশি সরকারি অফিসও সবসময় জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
তাঁর সবচেয়ে ক্যারিসমেটিক বিষয় হলো তিনি রাজনৈতিক প্রতিপ বা প্রতিদ্বন্দ্বিকেও সহজে বশে আনতে সম হন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক শিষ্টাচার যেখানে প্রায় লুপ্ত, সেখানে তাঁর অবস্থাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন এবং তাঁর কর্মিদের উপর যারা নির্যাতন করেছিল, তিনি সেই প্রতিদ্বন্দ্বিকেও গ্রহন করেন আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার সাথে। তাঁর আরেকটি বড় গুণ হলো তিনি একজন নিরপেক্ষ সালিশ বিচারক। রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি তিনি সমানভাবে সামাজিক অঙ্গনেও জনপ্রিয়। তাঁর নির্বাচনী এলাকা নবীগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন উপজেলায় বড়ো বড়ো বিচার-বৈঠকে জটিল সমস্যা সমাধানে তিনি ছুটে যান এবং নিরপেক্ষভাবে সমাধানের চেষ্টা করেন। এমনও দেখা গেছে যে, যাঁরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে অনেক কষ্ট করে সালিশ বিচারে নিয়েছেন, কিন্তু রায় দিয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে। প্রশাসনিক কার্যও যথা সম্ভব সচ্ছতার, সততা ও জবাবদিহিতার সাথে করে যাচ্ছেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি নবীগঞ্জ উপজেলার ৪ নম্বর দীঘলবাক ইউনিয়নের কামারগাঁও গ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবক ও অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম চৌধুরীর তৃতীয় সন্তান শাহিনূর আক্তার চৌধুরী পান্নার সাথে ১৯৯৯ খ্রি. প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। শাহিনূর আক্তার চৌধুরী পেশাগত জীবনে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সুগৃহীনি। স্বামীর ব্যস্ততার কারণে তাঁর কাঁধেই পুরো পরিবারের দায়িত্ব। তাঁদের তিন কন্যা ও এক পুত্র। শুরু করেছিলাম নবীগঞ্জ উপজেলার গুণীজনদের কথা দিয়ে। এই নবীগঞ্জের সার্থক সন্তান ‘সেলিম ভাই’। যিনি তাঁর মেধা, মনন, অর্থ, অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন নবীগঞ্জের মানুষের কল্যাণে। তাঁর অনুজ জহিরুল হক চৌধুরী সুমন আমেরিকা প্রবাসী। প্রবাসে জীবনযাপন করলেও জন্ম মাটির টান অন্তরে অনুভব করেন। সেই অনুভূতি থেকেই নিজের সহপাঠীদের সার্বিক সহযোগিতা ও অগ্রজের পরামর্শে স্থাপন করেছেন নিজের খ্যাতিমান পিতা প্রয়াত আব্দুল হক চৌধুরী’র নামানুসারে নবীগঞ্জের প্রথম চক্ষু চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ‘আব্দুল হক চৌধুরী চক্ষু হাসপাতাল’। এ থেকে সেবা পাচ্ছেন নবীগঞ্জসহ আশেপাশের এলাকার মানুষ। আমাদের এই দেশ ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, দু লক্ষ মা-বোনদের সম্ভ্রম ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত। এই দেশকে কোন সরকার কিংবা ব্যক্তি একার পক্ষে গড়া কখনোই সম্ভব হবে না। আর তাই এই দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহবান জানাই।
লেখক : গবেষক, রাজনৈতিক কর্মী; সদস্য সচিব, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, নবীগঞ্জ উপজেলা, হবিগঞ্জ।


     এই বিভাগের আরো খবর