,

সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে মানব পাচারের জাল

সময় ডেস্ক : ‘আট লাখ টেকায় ইতালি পৌঁছাইয়া দিত কইয়া (বলে) আমার পুয়ারে (ছেলে) লিবিয়া নিছে (নেয়), হখানো (ওখানে) নিয়া ১৫ দিন বন্দি রাইক্কা (রেখে) মারপিট কইরা পুয়ারে দিয়া আরও চাইর লাখ টেকা দেওয়ার লাগি ফোন করাইছে। টেকা দেওয়ার পরে পুয়াটারে ছাড়ছে, অখন (এখন) আমার পুয়া হখানো (ওখানে) আরেকজনের কাছে আছে। বিছনা (বিছানা) থাকি ওঠতো পারে না।’ সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের নৈনগাঁও গ্রামের তোফায়েল আহমেদের মা আম্বিয়া বেগম সাংবাদিকদের কাছে এভাবেই জানাচ্ছিলেন তাঁর কষ্টের কথা। ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে দোয়ারাবাজারের মানব পাচারকারী সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে মাস দেড়েক আগে টাকা লেনদেন করেন ওই যুবক।
আম্বিয়া বেগম জানালেন, তাঁর ছেলেকে ৮ লাখ টাকায় ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল সাহাব উদ্দিনের। লিবিয়া যাওয়ার পর তাঁর ছেলেকে আটকে রেখে বেধড়ক মারধর করে আরও ৪ লাখ টাকা চায় সাহাব উদ্দিনের ভাই লিবিয়ায় অবস্থানরত রাজা মিয়া। ছেলের কান্নাকাটিতে জমিজমা বিক্রি করে আরও ৪ লাখ টাকা দিয়েছেন তাঁরা। সাহাব উদ্দিনের ভাই রাজা মিয়া লিবিয়া থেকে এসব অপকর্ম করেন, এখানে তার হয়ে টাকা নেন সাহাব উদ্দিন।
এ দুই ভাইয়ের খপ্পরে শুধু তোফায়েল নন, দোয়ারাবাজারের ইদনপুর গ্রামের মনির আলীর ছেলে মঞ্জু মিয়া, একই গ্রামের চান মিয়ার ছেলে মিনহাজ উদ্দিন, ছাতকের নোয়ারাই গ্রামের সমুজ আলীর ছেলে মাহবুব হোসেনসহ কমপক্ষে ২৫ জন তাঁদের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে গড়ে ১২ লাখ টাকা করে নিলে এ সংখ্যাটি দাঁড়ায় তিন কোটিরও বেশি। এর বাইরে সারা জেলায় গড়ে উঠেছে এ মানব পাচার চক্রের জাল।
সাহাব উদ্দিন ও রাজা মিয়া ছাড়াও জেলাজুড়ে মানব পাচারকারীদের দালাল ছড়িয়ে পড়েছে। ইতালি, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন নেওয়ার মিথ্যা লোভনীয় কথা বলে গ্রামের বিত্তশালী, মধ্যবিত্ত এমনকি দরিদ্র মানুষের জমিজমা বিক্রির লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। কাউকে কাউকে দুবাই হয়ে লিবিয়া নিয়ে বিপদগ্রস্ত করছে এই চক্র। কারও কারও প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। এই চক্রের হয়ে বিভিন্ন উপজেলায় কাজে নেমেছেন কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মীও।
গত ১৬ জুন পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে জেলার জগন্নাথপুরের এক তরুণের মৃত্যু ঘটেছে। ২৯ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তাঁর লাশ দেশে আসে। পরদিন জগন্নাথপুর থানা পুলিশ নিহতের সুরুতহাল রিপোর্ট তৈরি করে এবং ওই দিনই সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
পরে নিহত তরুণ একওয়ান ইসলামের বাবা তরিকুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ৩ অক্টোবর জগন্নাথপুর থানায় মামলা করেন। পুলিশ গত রোববার এই মামলার দুই আসামি আবুল মিয়া ও আসমা বেগমকে হবিগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে জেলার দিরাই উপজেলার তিন যুবক ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ট্রলারডুবিতে মারা যান। তাঁরা হলেন- উপজেলার সাকিতপুর গ্রামের ফুল মিয়া সরদারের ছেলে জুনু সরদার (৩৪), নতুন কর্ণগাঁও গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে জুনেদ আহমদ (২২) ও শাল্লা উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের আশুতোষ রায়ের ছেলে আকাশ রায় (২৫)।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে একইভাবে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ট্রলারডুবিতে মৃত্যু ঘটে দিরাই পৌর এলাকার চণ্ডীপুর গ্রামের আব্দুস সবুর মাস্টারের ছেলে মাহবুবুল আলমের। এই উপজেলার মানব পাচারকারী টুক দিরাই গ্রামের আব্দুল ওয়াহেদের ছেলে এনামুলের মাধ্যমে ইতালি যেতে দেশ ছেড়েছিলেন তাঁরা। গত ২৫ জানুয়ারি জামালগঞ্জের ভীমখালীর নরুল আমিন তালুকদারের ছেলে সাজ্জাদুর রহমান সুজন লিবিয়া থেকে ট্রলারে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ট্রলার ডুবে মারা যান।
নিহত সাজ্জাদুরের চাচাতো ভাই ভীমখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন জানান, শান্তিগঞ্জের লালুখালীর মফিজুর রহমানের ছেলে রাসেল আহমদের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করেছিলেন তার চাচা নুরুল আমিন তালুকদার।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোনে বারবার চেষ্টা করলেও ফোন বন্ধ থাকায় এনামুল ও রাসেলের সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
দোয়ারার সাহাব উদ্দিনের মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় প্রথমে পরিচয় না দিয়ে ইতালি যেতে আগ্রহের কথা জানিয়ে কী করতে হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডাইরেক্ট যেতে ১৭ লাখ লাগবে। সময় চার মাস দিতে হবে।’ দুবাই-লিবিয়া হয়ে পাঠানো যাবে জানিয়ে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে আটকে যায়। তবে যারা আটকা পড়েছিল, তাদের সবাইকে ছুটানো হয়েছে।’ এক পর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি বলেন, ‘আমি সরল বিশ্বাসে কথা বলেছি, দয়া করে আপনি এসব কথা পত্রিকায় দেবেন না দাদা।’ তিনি আরও জানান, নৈনগাঁওয়ের তোফায়েলের বিষয়টি ১৭ তারিখের (অক্টোবর) পর বসে মীমাংসা করা হবে। আটকে পড়া অন্যদেরও ইউরোপে ঢোকার ব্যবস্থা হবে বলে জানান তিনি।
গত সোমবার সংবাদ সম্মেলনে করে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের কঠোর অবস্থানের কথা জানান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আবু সাঈদ। তিনি মানব পাচারের ঘটনায় জগন্নাথপুরের দু’জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে বলেন, মানব পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে পুলিশ, কঠোর অ্যাকশনে যাবে। জেলাজুড়ে পাচারকারীদের তালিকা তৈরির কাজ হচ্ছে।


     এই বিভাগের আরো খবর