,

তুরস্ক-সিরিয়ায় স্মরণকালের বিধ্বংসী ভূমিকম্প

প্রতি ১০ মিনিটে উদ্ধার হচ্ছে একটি করে প্রাণহীন দেহ

তুরস্কে প্রাণহানি ১০ হাজার ছাড়াতে পারে :: ইউএসজিএস

সময় ডেস্ক : স্মরণকালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত তুরস্ক-সিরিয়ায় এখন চলছে শোকের মাতম। সোমবার ভোরের দিকে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এখনও অসংখ্য মানুষ ধসে যাওয়া হাজার হাজার ভবনের নিচে চাপা পড়ায় মৃতের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার প্রতিনিধি সুহাইব আল-খালাফ সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে বলেছেন, উদ্ধারকারীরা মরিয়া হয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে লোকজনকে বের করার চেষ্টা করছেন।
সুহাইব আল-খালাফ বলেন, ‘উদ্ধারকারীরা প্রত্যেক ১০ মিনিটে একটি করে মরদেহ বের করে আনছেন।’ সিরিয়াজুড়ে অসংখ্য ভবন ধসে পড়েছে। তিনি বলেন, এসব ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে শত শত মানুষ আটকা পড়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ‘মরদেহ বের করে আনার পর আমরা ধ্বংসস্তূপের ওপরে মানুষের আর্তনাদ দেখছি; তারা (উদ্ধারকারীরা) একটি শিশু পেয়েছে; সে জীবিত বলে মনে হচ্ছে। পরে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’
আল-জাজিরার এই প্রতিনিধি বলেন, সিরিয়ার দীর্ঘদিনের যুদ্ধের কারণে স্থানীয় চিকিৎসাসেবা খাত আগে থেকেই বিপর্যস্ত। ভূমিকম্পের কারণে হাজার হাজার মানুষ আহত হওয়ায় এখন সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। তিনি বলেন, লোকজনকে হাসপাতাল, এমনকি হাসপাতালের বারান্দায়ও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রক্তের প্রচুর সংকট দেখা দিয়েছে। দুই ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত তুরস্ক-সিরিয়ায় হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে লোকজনকে উদ্ধারের তৎপরতা আগামী কয়েক দিন ধরে চলতে পারে বলে সিরিয়া ও তুরস্কের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। তবে বৈরী আবহাওয়ার কারণে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তুরস্কের সরকারি তথ্য বলছে, সোমবার ভোরের প্রথম ভূমিকম্পে দেশটিতে অন্তত ২ হাজার ৮০০টি ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফলে দেশটিতে হাজার হাজার মানুষকে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে হতে পারে।
একজন বৃদ্ধা কুর্দি ভাষায় কান্নাকাটি করছেন। তার ভগ্নিপতি, ভাতিজি ও ভাগ্নেরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন। তাদের জীবিত উদ্ধারের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তিনি। কিছু অল্পবয়সী প্রতিবেশী তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ওই নারীকে সান্ত্বনা দিয়ে তারা বলছেন, ‘কয়েক মিনিট আগে একজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা আপনার পরিবারকেও উদ্ধার করবে।’ তবে ওই নারীর পরিবার ১২ তলা ভবনের নিচতলায় বসবাস করতেন; যে কারণে তাদের জীবিত উদ্ধারের ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী নন তিনি। তিনি বলেন, ‘তারা নিচতলায় ছিল। ঘুমাচ্ছিল। আমি জানি না কেউ তাদের কাছে পৌঁছাতে পারবে কি না… এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা। আমার বাচ্চাগুলো ধ্বংসস্তূপের নিচে জমে যাবে।’
তবে তুরস্কে এমন অসংখ্য পরিবারের খোঁজ পাওয়া গেছে, যাদের পরিবারের কোনো সদস্যেরই সন্ধান মিলছে না। এমনকি স্বজন হারানোর শোকে যে কান্না করবেন কিছু পরিবারে এমন একজনও জীবিত নেই। তুরস্কের একটি শহরের উদ্ধার তৎপরতার দৃশ্য তুলে ধরে বিবিসি লিখেছে, উদ্ধারযজ্ঞ চলার সময় আকস্মিকভাবে জনতা উচ্চস্বরে চিৎকার করছেন। তাদের হাততালি দিতেও দেখা যাচ্ছে। উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে কারও কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথে লোকজন চিৎকার করছেন।
তবে যাকে উদ্ধার করা হচ্ছে, তার কোনো আত্মীয় নন এই হাততালি দেওয়া লোকজন। কেউ একজন যে উদ্ধার হচ্ছে, তাতেই তারা খুশি। সেখানকার পরিস্থিতি বর্ণনায় বিবিসি বলছে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে নেমে আসে পিন-পতন নীরবতা। কারণ যাকে উদ্ধার করা হচ্ছে, তিনি মারা গেছেন।
বিবিসির তুরস্ক প্রতিনিধি হাতিস কামের দিয়ারবাকি থেকে বলেছেন, শহরটিতে হিমশীতল ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাতও হচ্ছে। আফটারশকের ভয়ে কোনো লোকজনই তাদের বাড়ির কাছাকাছি যেতে পারছেন না। যদিও তারা গভীর রাতে বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে চলে গেছেন… শীত নিবারণের জন্য জ্যাকেট এবং জুতো নেওয়ার জন্য বাড়ি ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছেন তারা।
ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে কেবল তুরস্কেই প্রাণহানির সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস। সংস্থাটি বলেছে, সোমবার ভোরে দক্ষিণ তুরস্কে আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং এটি এক লাখে পৌঁছারও কিছুটা আশঙ্কা আছে। ওই অঞ্চলের অতীতের ভূমিকম্প, সর্বাধিক কম্পনের আওতাধীন এলাকার জনসংখ্যার কাঠামো এবং সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত অঞ্চলের অবকাঠামোগত দুর্বলতার ওপর ভিত্তি করে এমন অনুমান করেছে ইউএসজিএস।
সংস্থাটি বলেছে, ভূমিকম্পে তুরস্কে প্রাণহানি এক হাজার থেকে ১০ হাজার জনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ৪৭ শতাংশ। আর ১০০ থেকে ১ হাজার জনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ২৭ শতাংশ। তবে ১০ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনাও রয়েছে, সেটি ২০ শতাংশ। ইউএসজিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেকর্ড মাত্রার এই ভূমিকম্পে ব্যাপক হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এই ভূমিকম্পের বিপর্যয় প্রবল হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
‘ওই অঞ্চলের মানুষ এমন অবকাঠামো ব্যবস্থায় বসবাস করেন, যেগুলো ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে কিছু ভূকম্পন প্রতিরোধী অবকাঠামোও রয়েছে সেখানে।’ ভূমিকম্পের আর্থিক ক্ষতি ১০০ কোটি ডলার থেকে এক হাজার কোটি ডলারের মধ্যে হতে পারে; যা তুরস্কের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশের সমান।


     এই বিভাগের আরো খবর