,

বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা নেই হাওরের কিশোর-কিশোরীদের

নিজস্ব প্রতিনিধি : হবিগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চল নামে খ্যাত বানিয়াচংয়ের পাঠানটুলা গ্রামের কিশোরি জোনাকি আক্তার (১৪)। গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সময় দরিদ্রতার কারণে গৃহকর্মীর কাজ শুরু করে। বয়ঃসন্ধিকাল বলতে কিছু আছে এ ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই তার। এরইমধ্যে তার ঋতুস্রাব শুরু হয়েছে, শারীরিক অনেক পরিবর্তনও হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে তার নূন্যতম ধারণা নেই। একই উপজেলার মন্দরী এসইএস ডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সীমা আক্তার বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন বিষয়ে কিছুটা পরিচিতি। পাঠ্যবইয়ের কল্যাণে এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলেও ঋতুস্রাব ছাড়া এ সময়ের অন্যান্য শারীরিক মানসিক পরিবর্তন সর্ম্পকে তার স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।
হাওর বললেই যে কারও চোখের সামনে ভেসে উঠবে বিশাল জলরাশি, গাছ, পাখি, মাঠভর্তি ফসলের ছড়াছড়ি। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে হাওরের নানা রূপ মানুষকে মুগ্ধ করে। এখানে ছয়মাস ডাঙ্গা আর ছয়মাস পানি। এরমধ্যেই হাওরবাসীর জীবনযাপন। নানা প্রতিকূলতা পার করতে হয় হাওরের মানুষজনকে। সেখানকার কিশোর-কিশোরীরাও এসব প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে উঠে। এসব এলাকায় শিক্ষার হার কম, ধর্মীয় গোঁড়ামি বেশি। তাই কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন নিয়ে অসচেতন তাদের পরিবারের সদস্যরাও। ফলে এই সময়ের শারিরীক ও মানসিক পরিবর্তনসহ নিজেদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ হাওরপাড়ের কিশোর-কিশোরীরা।
হাওরের কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানা বিষয়ে জানতে গত নভেম্বরে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার বেশ কয়েকটি এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করেন এই প্রতিবেদক। সেসব এলাকার শতাধিক কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে কথা হয়। কথা হয় তাদের পরিবারের সদস্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে।
বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে, দেশে মোট ৪১৪টি হাওর আছে। এরমধ্যে শুধু সিলেট বিভাগেই আছে ২০৮টি হাওর। বাকি ২০৬টি হাওর আছে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলায়।
বানিয়াচংয়ের মন্দরী এসইএস ডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রনি আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। ‘বয়ঃসন্ধিকাল বিষয়ে ৫ম শ্রেণীর বইয়ে পড়ছি, কিন্তু কিচ্ছু বুঝছি না। আমার যখন শরীরখারাপ (ঋতুস্রাব) হয় তখন এই সম্পর্কে আমি কিছু জানতাম না। বাড়িতেও কেউ কোনোদিন আমার সঙ্গে এই বিষয়ে মাতছে না (কথা বলেনি)। একদিন স্কুলে আওয়ার পর আমার শরীর খারাপ হয়। তখন আমি ডরাইয়া (ভয়ে) কান্দা (কান্না) শুরু করি। পরে প্রধান শিক্ষক আমার ক্লাসের বান্ধবিরারে দিয়া আমারে বাড়িত পাঠাইন’-রনি আক্তার জানায়।
রনি আক্তারের মত প্রায় একই অভিজ্ঞতা এই প্রতিবেদকের কাছে জানায় ওই প্রতিষ্ঠানের ৮ম শ্রেণীর ১৬জন ছাত্রী। আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম ও ৯ম শ্রেণীর প্রায় শতাধিক ছাত্রী তাদের বয়ঃসন্ধিকাল শুরুর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে। তারা জানিয়েছে, বয়ঃসন্ধিকালে শারিরীক পরিবর্তনটা কিছুটা আঁচ করতে পারলেও মানসিক পরিবর্তনের বিষয়টি তারা জানতোই না। এসব বিষয়ে তাদের পরিবারের কেউ কখনো তাদের সঙ্গে কথা বলেনি। সামান্য যা জানতে পেরেছে তা বিদ্যালয়ে আসা বিভিন্ন এনজিওর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
হাওর এলাকার বিদ্যালয়গামী কিশোরী ও তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঋতুস্রাবের সময় ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে আসে না। অনেক বিদ্যালয়ে অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার ও কোনো বিশ্রামাগার না থাকার কারণে ওই সময় ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে আসতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে না। তবে গুটিকয়েক বিদ্যালয়ে ভাল শৌচাগার থাকলেও ওই সময় বিদ্যালয়ে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না ছাত্রীরা। কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকালে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কারণ এই সময়ের শারীরিক বা মানসিক কোনো পরিবর্তন সম্পর্কেই ছেলেদেরকে পরিবার থেকে ধারণা দেয়া হয় না।
চিকিৎসকদের মতে, মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেদের চেয়ে কিছুটা আগে শুরু হয়। মূলত ১০ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে যেকোনো সময় তা হতে পারে। অন্যদিকে ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়:সন্ধিকাল আসে ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে। এ সময়ে মেয়েদের উচ্চতা বাড়ে। শরীরের বিভিন্ন অংশ স্ফীত হয়। বাহুমূল ও যৌনাঙ্গে লোম গজায়। মাসিক শুরু হয়। তেমনি ছেলেদের ক্ষেত্রে, এসময় তাদের দেহের উচ্চতা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে, গলার স্বর ভারি হয়ে আসে, কাঁধ চওড়া হয়, পেশী সুগঠিত হয়। মুখে দাড়ি-গোঁফ ওঠে সেইসঙ্গে শরীরের নানা জায়গায় বিশেষ করে, বুকে, বাহুমূলে ও যৌনাঙ্গে লোম গজায়।
বয়:সন্ধিকালে ছেলে-মেয়ে উভয়েরই প্রজনন ক্ষমতা বিকাশ হতে থাকে, তাই এসময় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ শুরু হয় কিশোর কিশোরীদের। তাই না বুঝেই প্রেম ও যৌন সম্পর্কে জড়ায় অনেক কিশোর-কিশোরী। পাশাপাশি এসময় তারা কৌতূহলপ্রবণ হওয়ায় অনেক সময় বিপথগামী হয়। অনেকে মাদকের নেশা ও অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ে। তাই এই সময়ে পরিবার থেকে ছেলে মেয়েদের সচেতনতা বেশি দরকার। পাশপাশি বয়ঃসন্ধিকালীন সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন বুঝতে ও এই সময়টা সঠিকভাবে পার করতে ছেলেমেয়েদের সবচেয়ে বেশি পরিবারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
হাওর এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই সময়ের পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে নানা কারণে জড়তার মধ্যে থাকেন। হাওরের বেশিরভাগ অভিভাবক মনে করেন, এসব পরিবর্তন সম্পর্কে নিজ থেকেই জানতে পারবে কিশোর কিশোরীরা।
সিলেট এমসি কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারি অধ্যাপক শামীমা রসূল বলেন, বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের শুরুতে কিশোর-কিশোরীরা ভয় পায়। তখন তাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। অভিবাবকরা এ সব বিষয় নিয়ে ধারণা দেন না। তিনি বলেন, অভিভাবকরা মনে করেন, আমরাওতো এমনিতে বড় হয়েছি। আমাদেরতো কেউ এসব বিষয়ে শিখায়নি। তাই তারা ছেলে মেয়েদের না বুঝিয়ে শাসন করেন বেশি। এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং করতে হবে। এই কাজটা অবশ্যই অনেক চ্যালেঞ্জিং। প্রথমে বিভিন্ন বাঁধা আসবে। কিন্তু ভাল ভাবে সমন্নয় করলে এই কাউন্সিলিংয়ের কাজটা করা সম্ভব। এতে করে আস্তে আস্তে বিষয়টা সবাই বুঝতে পারবে।


     এই বিভাগের আরো খবর