,

উচ্চ রক্তচাপ বাড়ছে শিশুদের

সময় ডেস্ক : যশোরের তিন বছর বয়সী ওয়াহিদা আক্তার। এক মাস আগে জ্বরে হঠাৎ খিঁচুনি শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে মুখমণ্ডল ও শরীর ফুলে যায়। স্থানীয় সদর হাসপাতালে ভর্তি হলে চিকিৎসকরা জানান, ওয়াহিদা কিডনিজনিত সমস্যায় ভুগছে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের কিডনি বিভাগে ভর্তি হয়। কিডনির সমস্যা ধরেই ওয়াহিদার চিকিৎসা শুরু করা হয়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায়, তার একটি কিডনি জন্মগতভাবেই কাজ করছে না। এক সপ্তাহ আগে চিকিৎসকরা জানান, ওয়াহিদার কিডনিজনিত সমস্যার কারণে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিয়েছে। এমনকি জটিল আকার ধারণ করেছে। পাঁচ থেকে ছয় ধরনের ওষুধ দিয়েও তার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এখনও চিকিৎসাধীন এ শিশুটি।
চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা মহামারির পর শিশুদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের হার বাড়ছে। অন্যান্য রোগ, যেমন হৃদরোগ, কিডনিজনিত সমস্যা, ডায়াবেটিস, টিউমার, ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুর মধ্যে এই রোগীর সংখ্যা বেশি মিলছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এটি শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তে শিশুদের স্কুলগুলোতে উচ্চ রক্তচাপ পরিমাপের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের স্কুল হেলথ ক্লিনিকগুলোকে আরও শক্তিশালী করার তাগিদ তাদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২২ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের ১০০ জনের ১৩ জনই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এদের মধ্যে অন্তত ৫ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, উচ্চ রক্তচাপের দোসর অস্বাভাবিক কিডনিজনিত সমস্যা এবং স্থূলতা। দেশে এ রোগে আক্রান্ত প্রায় দেড় কোটি মানুষ।
রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের কিডনিজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, এ সমস্যায় আক্রান্ত ৭৬ ভাগ শিশুর উচ্চ রক্তচাপ পাওয়া গেছে। এছাড়া কিডনি সমস্যা, টিউমার, ক্যান্সার, হরমোনাল ও নিয়মিত কিছু ওষুধ সেবন করছে– এমন শিশুর উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। শিশু হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি উচ্চ রক্তচাপের রোগী মিলছে, বিশেষ করে যাদের আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ছয় বছরের বেশি বয়সী শিশুদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ বেশি। অনুমান, করোনার পর উচ্চ রক্তচাপের রোগী বেশি আসছে।
শিশু হাসপাতালের কিডনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শিরিন আফরোজ বলেন, বড়দের উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোকের মতো নানা জটিল রোগ দেখা দেয়। আর শিশুদের অন্য রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এটা যখন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়, তখন খিঁচুনি শুরু হয়। চোখে দেখতে পারে না। মাথাব্যথা, বমি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। কিডনি থেকে অভ্যন্তরীণ রক্ত যেতে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ শনাক্ত করতে পারলে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তবে শনাক্তে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যে গাইডলাইন বের করা হয়েছে, সেখানে বাচ্চাদের উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের উদ্যোগে ‘শিশু স্বাস্থ্য, বিকাশ ও সুরক্ষা’ শীর্ষক ২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, যার মধ্যে ছেলে শিশুর সংখ্যা বেশি। অতিরিক্ত সময় বসে থাকা, স্থূলতা এবং শারীরিক পরিশ্রম না করা শিশুদের ঝুঁকি বেশি।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, উচ্চ রক্তচাপ একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্ক ১০০ জনের মধ্যে ২১ জনের উচ্চ রক্তচাপ আছে। ২০২২ সালে এটি বেড়ে ২৪ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে এখন শিশুদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের হার বেড়েছে। জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের সঙ্গে এর হার বেড়েছে। এখন কিশোর-কিশোরীরা অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুড ও ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়েছে। শরীরচর্চা কমিয়ে দিয়েছে। খেলাধুলার পরিবেশ না থাকায় বাচ্চারা ঘরবন্দি থাকায় স্থূলতা বেশি দেখা দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে আরও উদ্বেগজনক হারে শিশুদের মধ্যে এ সমস্যা দেখা দেবে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের উচ্চ রক্তচাপ কর্মসূচির ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার ডা. শামীম জুবায়ের বলেন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকার একটি অ্যাপের মাধ্যমে ১৮২টি উপজেলা ও চারটি জেলা হাসপাতালে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে। গত পাঁচ বছরে তিন লাখ রোগী এই সেবা নিচ্ছেন। বিনামূল্যে ওষুধসেবা দিচ্ছে সরকার। নিয়মিত ওষুধ নিচ্ছেন এমন ৫৪ শতাংশ রোগীর এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে নিবন্ধন করার পরও ২০ শতাংশ রোগী ওষুধ নিচ্ছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবদ আমিন বলেন, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত দেড় কোটি মানুষ জানে না তারা এই রোগে ভুগছেন। শিশুদের মধ্যে এই হার বেশি। এ জন্য স্ক্রিনিংয়ে জোর দিতে হবে। শিশুদের উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তে স্কুল হেলথ ক্লিনিকগুলো আবার সক্রিয় করতে হবে। করোনার সময় ২০০টি স্কুল হেলথ ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যায়। সেগুলো চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে।


     এই বিভাগের আরো খবর