,

উদ্যোক্তা সৃষ্টির সম্ভাবনাময় খাত প্রাণিসম্পদ বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছে শিক্ষিত নারী-পুরুষ শূন্য থেকে হচ্ছে স্বাবলম্বী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এমবিএ শেষ করে চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন ঝিনাদহের জেসমিন খাতুন। ২০১৮ সালে সিদ্ধান্ত নেন গরু পালনের। স্বামীর গচ্ছিত ৩ লাখ টাকা আর শশুরবাড়ির ৮টি গরু দিয়ে শুরু করেন খামারের কার্যক্রম। সংসার সামলানোর পর পুরো সময়টাই লেগে থাকেন খামারের পেছনে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি কালিগঞ্জ উপজেলার ছোট ঘিঘাটি গ্রামের গৃহবধু জেসমিনের। এখন তিনি একজন সফল খামারি। ফাতেমা এগ্রো এন্ড ডেইরী ফার্ম নামে তার গড়া খামারে বর্তমানে নেপালি, শাহীওয়াল, হলিস্টিন ফ্রিজিয়ানসহ বিভিন্ন প্রজাতির মোট ৬০টি গরু রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১৪০ লিটার দুধ সংগ্রহ করেন। দুধ বিক্রি করে প্রতিমাসে ২ লক্ষ টাকা আয় হয় তার। লেখা পড়া শেষ করে নিজেরই যেখানে অন্যের অধীনে চাকরি করার কথা সেখানে তার ফার্মে বর্তমানে ৬ জন কর্মচারীকে কাজ দিয়েছেন। জেসমিন খাতুন বলেন, ‘২০০৯ সালে উত্তর নারায়নপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১১ সালে আব্দুর রউপ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করি। এরপর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করে বসেই ছিলাম। বাচ্চা ছোট থাকায় চাকরি প্রস্তুতি নেইনি। স্বামীর সাথে পরামর্শ করে গরুর খামার শুরু করি। এখন খামারে প্রায় দেড় কোটি টাকার গরু রয়েছে।’
খুলনার ডুমুরিয়ার ধানিয়াবুনিয়ার এস এস ইন্টারন্যাশনাল এগ্রোর মালিক জি এম শফিকুল ইসলাম ২০১৬ সালে তার খামারটি শুরু করেন। বর্তমানে সেখানে মোট ৫৭টি গবাদিপশু রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি বকনা এবং ১৯টি বাছুর। এগুলো মূলত ফ্রিজিয়ান ক্রস, জার্সি ক্রস এবং ফ্রিজিয়ান শাহীওয়াল। এদের লালন-পালনের জন্য ৮ জন কর্মচারী সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রয়েছে। খামারটিতে গড়ে দুধ উৎপাদিত হয় ২৬০ লিটার এবং একক সর্বোচ্চ দৈনিক দুধ উৎপাদনের পরিমান ৩০ লিটার। খামারটির বার্ষিক মোট আয় ৫১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। এ খামারটির কারণে সম্প্রতি ডেইরী আইকন পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার মথুর ভাঙ্গা গ্রামের খামারি ও সাথি ডেইরী ফার্মের স্বত্ত্বাধিকারী সাথি আক্তার জানান, বিয়ের পর বাবার বাড়ি থেকে উপহার পাওয়া একটি গাভী দিয়ে শুরু করে এখন তিনি একটি নিবন্ধিত (নিবন্ধন নং রাজ/ সি সি ৩৬) খামারের মালিক। তার খামারে উৎপাদিত ও বাহির থেকে কেনা জার্সি, হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান, শাহিওয়াল এবং দেশীয় ক্রসসহ মোট ১৭টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি বাচ্চা ও ১০টি গাভী। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে এ খামারে কার্যক্রম শুরু করার পর প্রশিক্ষণ নিয়ে খামার পরিচালনা করছেন। বর্তমানে ৭টা গরু থেকে প্রতিদিন গড়ে ১১০ থেকে ১২০ লিটার দুধ পাওয়া যাচ্ছে। এই খামারের আয় দিয়ে এ পর্যন্ত ১০ লক্ষ টাকায় ২ কাঠা জমি কিনেছেন। সেই জমির উপর ৫ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে করছেন বাড়ির কাজও। এছাড়া গড়ে তুলেছেন একটি ভ্যারাইটিজ স্টোরও। তার এই সাফল্যে আশপাশের প্রায় শ’খানেক পরিবার অনুপ্রাণিত হয়ে ছোট পরিসরে খামার শুরু করেছেন বলেও জানান তিনি।
শুধু জেসমিন খাতুন, শফিকুল ইসলাম কিংবা সাথি আক্তারই নয়, বাংলার আনাচে কানাচে এমন সফল উদ্যোক্তা সংখ্যা অসংখ্য। শিক্ষাজীবন শেষ করে সন্তোষজনক চাকরি না পেয়ে যেসব জীবন অন্ধকারে মিলিয়ে যেত পারত, সেসব জীবন এখন প্রাণিসম্পদ খাতে সূর্যের আলোর মতো ঝলমল করছে। জীবিকার তাগিদে একসময় যারা অনিশ্চিত এক জীবনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল উদ্যোক্তা হয়ে তারাই একেকটি সফল জীবনের উদাহরণ হচ্ছেন। অনেকেই খুঁজে পেয়েছেন জীবনের দিশা। শুন্য থেকে বনে গেছেন লাখপতি। পাশাপাশি প্রাণিজ আমিষের বার্ষিক চাহিদার প্রেক্ষিতে গত এক দশকে দেশে পশুপালন খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। বাজারে বাণিজ্যিকভাবে দুধ ও মাংস সরবরাহের ব্যবসায় নেমেছেন নতুন অনেক খামারি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, শুধুমাত্র গত দশ বছরে দেশে খামার বেড়েছে ১০ লাখ ২ হাজার, যেখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে ছিল ৩ লাখ ৪৭ হাজার। এ সময়ে গরুর খামার বেড়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৪০, আগে ছিল ৭৯ হাজার ৮৫০। ছাগল ভেড়ার খামার বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৬৩০। আগে ছিল ৭৮ হাজার ৫৭০, পোলট্রি বেড়েছে ১ লাখ ৬০০, আগে ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৫০০। বেড়েছে ফিড মিল, মিট ও মিল্ক প্রসেসিং প্লান্ট। এই মুহূর্তে দেশে রেজিস্টার্ড গবাদি পশুর খামার ৭৮ হাজার ৬৮৪টি এবং পোলট্রি খামার হচ্ছে ৮৬ হাজার ৫৪১। কর্মসংস্থান ৫৪ লাখ ২০ হাজার মানুষের। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাঃ মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বলেন, টেকসই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ খাত বর্তমানে অগ্রগণ্য খাত হিসেবে বিবেচিত। প্রাণিজ আমিষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের পাশাপাশি স্বল্প বিনিয়োগে চাকরির বিকল্প কর্মসংস্থানে এ খাতের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য নি:সন্দেহে এটি একটি সম্ভবনাময় খাত। তিনি বলেন, বর্তমানে কম ঝুঁকি ও বেশি লাভজনক হওয়ায় অনেক শিক্ষিত নারী-পুরুষ খামারের দিকে ঝুঁকছেন। অনার্স মাস্টার্স পাশ করে এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেখাপড়া শেষ করেও আজ খামারি হচ্ছে। এটা খুবই ভালো দিক। কারণ শিক্ষিত মানুষ বুঝেশুনে প্রশিক্ষণ নিয়ে খামারের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হলে সফলতা মোটামুটি নিশ্চিত। এদিকে দুধ ও মাংস উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন রয়েছে ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)’। এতে মোট বিনিয়োগ ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। যা প্রাণিসম্পদ সেক্টরে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। তবে এ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হবে। দেশে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি, গাভী-ষাঁড়, ছাগল-ভেড়া এবং হাঁস-মুরগির উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি প্রদর্শনী দ্বারা খামারিদের দক্ষতা উন্নয়ন, দুগ্ধ বিপণনের জন্য বাজার সংযোগ, পণ্য বহুমুখীকরণ, মূল্য সংযোজন, স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রাণিজাত আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ফুড সেফটি নিশ্চিতকরণে উৎপাদনকারী, পরিবহনকারী, ব্যবসায়ী, কারিগর, ভোক্তা সব স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে এ প্রকল্প। যা খামারি তথা উদ্যোক্তাদের জন্যও বেশ সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী বলেন, দেশের ৬১ জেলার ৪৬৬ উপজেলায় খামার, খামারি এবং পশুভিত্তিক ৫৫০০ প্রোডিউসার গ্রুপ (পিজি) গঠন করা হয়েছে। পিজিতে এক লাখ ৯০ হাজার খামারিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তালিকাভুক্তদের জন্য থাকবে ফিল্ড স্কুল। যেখানে খামারিদের খামার আধুনিকায়ন, দক্ষতা উন্নয়ন, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করানো, উৎপাদিত দুধ, মাংস ও ডিমের হাইজিন নিশ্চিত করা, দুধ ও মাংসের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং খামারে উৎপাদিত পণ্যের বিপণন ব্যবস্থাপনার উপরেও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেয়া হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, মৎস্য ও গবাদিপশু পালন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগের জন্য একটি বড় ও সম্ভাবনাময় খাত। এ খাতে কাজের ক্ষেত্র অনেক বেশি সম্প্রসারিত। দেশের বাইরে থেকে আসা এবং দেশের অসংখ্য বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এ খাতে। পাশাপাশি দারিদ্য দূরীকরণে গ্রামীন অর্থনীতিকে সচল করা এবং মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদার বিশাল যোগান দিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে প্রাণিসম্পদ খাত। তিনি বলেন, প্রাণিজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ খাতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে প্রাণিসম্পদ খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কৃষিবিদ, বিজ্ঞানী, খামারি ও উদ্যোক্তাদের একযোগে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।


     এই বিভাগের আরো খবর