মো. আবু হানিফ বিন সাঈদ
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে এক ধরনের প্রাচীন শাসন ব্যবস্থা হিসেবে ‘সর্দারি প্রথা’ পরিচিত। এটি একসময় শাসকশ্রেণির অংশ ছিল, তবে বর্তমানে নানা আকারে সমাজে বিদ্যমান। এই প্রথা মূলত একটি ক্ষমতাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যা আজকের বাংলাদেশে গ্রাম্য রাজনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সর্দারি প্রথার ইতিহাস- সর্দারি প্রথার সূচনা ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। ইংরেজরা গ্রামীণ অঞ্চলে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু স্থানীয় নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। এই স্থানীয় নেতারা রাজস্ব আদায়, বিচারব্যবস্থা পরিচালনা এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে এই সর্দাররা স্থানীয় সমাজে প্রভাব বিস্তার করে এবং গ্রামবাসী তাদের নেতৃত্ব মেনে নিত। ব্রিটিশ শাসনের পর পাকিস্তানি আমলেও সর্দারি প্রথার অস্তিত্ব ছিল এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশেও তা টিকে থাকে।
আজকের গ্রাম্য রাজনীতি: সর্দারি প্রথার আধিপত্য- আজকের বাংলাদেশে, সর্দারি প্রথা আর এককভাবে প্রশাসনিক কাঠামোর অংশ নয় বরং এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এখনো একধরনের সর্দারের মতো কাজ করেন। তাদের নেতৃত্বে এলাকার মানুষের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ তাদের অধিকাংশ সিদ্ধান্তে তাদের প্রভাবকে অনুভব করে এবং একে সমর্থন দেয়।
সর্দারি প্রথার প্রভাব- গ্রাম্য সমাজে সর্দারি প্রথা গভীরভাবে প্রবল ও প্রভাবশালী। যেখানে একসময় রাজস্ব আদায়, বিচার বা শান্তিরক্ষায় সর্দারের ভূমিকা ছিল, বর্তমানে সেই প্রভাব অনেকাংশে রাজনীতি, সামাজিক স্তর ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের দিকে পোঁছে গেছে। একটি বড় সমস্যা হলো ‘পক্ষপাতিত্ব’। সর্দারের প্রভাবের কারণে, সাধারণ মানুষ অনেক সময় তাদের অধিকার আদায় করতে পারেন না। জমি-বাড়ির বিরোধ থেকে শুরু করে পারিবারিক সমস্যা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবিলা- এগুলোর সবই সর্দারদের হাতে চলে যায়।
সর্দাররা মাঝে মাঝে অপ্রতিরোধ্য শক্তির মতো আচরণ করে। সমাজের ন্যায়বিচার ব্যবস্থায় তাদের প্রভাব এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, প্রশাসনিক কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। এর ফলে, সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং আইনগত সহায়তা পেতে অনেক সময় অক্ষম হয়ে পড়েন।
সর্দারি প্রথার বিরুদ্ধাচারণ- গ্রাম্য সমাজে আধুনিকতা ও সচেতনতার বিকাশ হলে সর্দারি প্রথার প্রভাব কিছুটা কমে যাবে। শিক্ষিত সমাজের অনেকেই গ্রাম্য রাজনীতি ও সর্দারি প্রথাকে প্রথাগত একটি সমস্যারূপে দেখছেন। তারা জানে যে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় জনগণের বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নই তাদের ভবিষ্যতের জন্য ভালো।
এছাড়া, শহরাঞ্চলে বেড়ে ওঠা যুবকরা গ্রামাঞ্চলের শাসন ব্যবস্থায় যুক্ত হয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসছে। তারা মনে করে, গ্রামে অধিকারপ্রাপ্ত, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যেখানে কোনো ব্যক্তির একক আধিপত্য থাকবে না।
শিক্ষিত সমাজের ভূমিকা- শিক্ষিত সমাজ বর্তমানে গ্রাম্য সমাজের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছে। তারা গ্রামে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে গ্রামবাসীকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়। শিক্ষিত সমাজের কাছে গ্রামের মানুষ বেশি সহজে তাদের সমস্যা তুলে ধরতে পারেন এবং তাদের বিচার ও আইনগত সাহায্য পাওয়ার সুযোগ বাড়ে।
করণীয়
গ্রামের সমাজে সর্দারি প্রথার প্রভাব কমানোর জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত:
১. শিক্ষার প্রসার: গ্রামের মানুষের মাঝে শিক্ষার প্রসার ঘটানো জরুরি। শিক্ষিত মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং সর্দারি প্রথার বিপক্ষে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।
২. আইন ও বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা: গ্রামের স্থানীয় প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে জনগণের মধ্যে সঠিক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি: গ্রামে গ্রামে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো উচিত। এতে করে গ্রামবাসী তাদের অধিকার ও আইনি সাহায্য সম্পর্কে জানবে।
৪. নেতৃত্বের পরিবর্তন: পুরোনো প্রথাগুলোর বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদের যথাযথ ভূমিকা দেওয়া।
উপসংহার- এখনও বাংলাদেশে গ্রাম্য রাজনীতি ও সর্দারি প্রথা অত্যন্ত প্রভাবশালী, তবে বর্তমান সমাজে এটি পরিবর্তনের মুখে। সচেতনতা, শিক্ষা এবং সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠলে, এই প্রথার আধিপত্য কমে যাবে। সমাজের উন্নতির জন্য গ্রামীণ রাজনীতি ও সর্দারি প্রথা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি এবং সেই পথে অগ্রসর হতে হলে গণতান্ত্রিক এবং আইনশৃঙ্খলা পূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
Leave a Reply